সাইবার হামলার শিকার গৃহবধূর ত্রাণকর্তা হয়ে এলো পুলিশ

স্বামী ও সংসার নিয়ে ভালোই সময় কাটছিল মিষ্টির (ছদ্মনাম)। চাকরির সুবাধে স্বামী অফিসে চলে যাওয়ার পর ঘরের কাজ সেরে অবসর কাটাতেন অনলাইন তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই।
গত ১৫ ডিসেম্বর অনলাইনেই এক নারীর সঙ্গে পরিচয় হয় মিষ্টির। অপরিচিত ওই নারীর সঙ্গে দ্রুত গড়ে ওঠে সখ্যতা। ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে ওই নারীর সঙ্গে দুদিন নানা বিষয়ে কথা হয় মিষ্টির। তৃতীয় দিনের মাথায় ওই নারী একটি লিংক পাঠিয়ে কৌশলে মিষ্টির ফেসবুক আইডি দখলে নিয়ে নেন।
এরপর থেকেই শুরু হয় সমস্যা। আইডিটি নিয়ন্ত্রণে নিয়েই ওই নারী প্রথমে মিষ্টির কিছু ব্যক্তিগত ভিডিও, ছবি এবং তথ্য নিয়ে নেন। এরপর ফেসবুক আইডি ও গোপন ব্যক্তিগত তথ্যগুলো ফিরিয়ে দিতে বিকাশে টাকা চান ওই প্রতারক নারী। তার কথা অনুযায়ী তাকে টাকাও পাঠিয়েছিলেন মিষ্টি। কিন্তু আইডি ও তথ্য ফিরিয়ে না দিয়ে নানা টালবাহানা শুরু করে সে।
কিছুদিন পর মিষ্টিকে অনলাইনে অনৈতিক কাজের প্রস্তাব দেন ওই সাইবার প্রতারক। মিষ্টি এতে রাজি না হয়ে তার স্বামীকে বিষয়টি জানান। এরপর প্রতারকের সঙ্গে কথা বলেন তার (মিষ্টি) স্বামী। তখন তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। কিন্তু টাকা না পেয়ে ওই প্রতারক মিষ্টির কিছু গোপন ছবি এডিট করে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন ও আত্মীয়দের কাছে পাঠাতে থাকেন।
এতে প্রচণ্ড মানসিক ও পারিবারিক চাপ সৃষ্টি হয় মিষ্টির ওপর। এসব ঘটনায় সম্পূর্ণ ‘ভেঙে পড়েন’ সে। এমন অসম্মান থেকে ‘বাঁচতে’ নিয়েছিলেন আত্মহত্যার সিদ্ধান্তও। এমতাবস্থায় এক বন্ধুর কাছ থেকে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) সেন্টারের কথা জানতে পারেন তিনি। বন্ধুর কথা শুনে পিসিএসডব্লিউ’র হটলাইনে ফোন দিয়ে কোনো কথা না বলে কান্না করতে থাকেন মিষ্টি। একটু পর কান্না থামিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাকে কি আপনারা বাঁচাতে পারবেন? আমি বাঁচতে চাই’।
পিসিএসডব্লিউ সূত্রে জানা গেছে, মিষ্টি ফোনে এতটাই কাঁদছিলেন, তার কোনো কথা বোঝা যাচ্ছিল না। পরে তার কথা শুনে তাকে প্রথমেই ভরসা দেন পিসিএসডব্লিউ-এর কর্মকর্তারা। অনেকক্ষণ কথা বলে তার (মিষ্টি) সমস্যার কথা জানতে পারে পিসিএসডব্লিউ। এরপরই তার সহায়তায় এগিয়ে আসে পুলিশের এই বিশেষ ইউনিট।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিসিএসডব্লিউ-এর পুলিশ সুপার (এসপি) পদ মর্যাদার এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইনি প্রক্রিয়ায় মিষ্টিকে আমরা নিয়ে আসি। এদিকে হ্যাকারও কিন্তু থেমে ছিল না। সে তার মতো করে বাজে ছবি, ম্যাসেজ দিয়ে যাচ্ছিলেন, ভয়ভীতিও দেখিয়েছেন।’
সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের তদন্তকারী দল তখন একইসঙ্গে দুইটি কাজ শুরু করে। মিষ্টি ও তার পরিবারকে নিয়মিত কাউন্সেলিং দেওয়া ও অপরাধীকে খুঁজে বের করা। সর্বশেষ তদন্তকারী দল প্রযুক্তিগত সহায়তা সিলেটের একটি জেলা থেকে এই প্রতারক চক্রের তিন জনকে গ্রেফতার করে। তাদের গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন মিষ্টি ও তার পরিবার।
পিসিএসডব্লিউ-এর এসপি পদের এক কর্মকর্তা
তবে শুধু মিষ্টি নয়, এভাবে নারীদের সহায়তা করে যাচ্ছে পুলিশের বিশেষ এ ইউনিট। পুলিশ সদর দফতরের এ ইউনিটটির যাত্রা শুরু হয় গত বছরের ১৬ নভেম্বর। যাত্রা শুরুর পর এ পর্যন্ত হটলাইনে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি নারী তাদের কাছে কল করেছেন। এর মধ্যে ফেইক ফেসবুক আইডি সংক্রান্ত অভিযোগ ২৩ শতাংশ, আইডি হ্যাক সংক্রান্ত ১৩ শতাংশ, ব্ল্যাকমেইলিং সংক্রান্ত আট শতাংশ, মোবাইলে হয়রানি সংক্রান্ত ৯ শতাংশ, অশ্লীল জিনিসপত্র পাঠানো সংক্রান্ত সাত শতাংশ, অন্যান্য ৯ শতাংশ ও অপ্রাসঙ্গিক অভিযোগ আসে ২৭ শতাংশ। এছাড়া পিসিএসডব্লিউ’র ফেসবুক পেইজেও সাইবার নিরাপত্তার জন্য অসংখ্য অভিযোগ আসে এখানে।
এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় পুলিশের এ বিশেষ ইউনিট। এসব অভিযোগের মধ্যে অধিকাংশের অভিযোগ তদন্ত করে ভিকটিমকে আইনি সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পিসিএসডব্লিউ।
পিসিএসডব্লিউ সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৬৮ শতাংশ নারী বিভিন্ন প্রকার সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। সেই ভুক্তভোগী নারীদের নিরাপত্তা ও আইনি সহায়তা দিতেই ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন ইউনিট’-এর সৃষ্টি।
তবে বেশিরভাগ অভিযোগ তদন্ত করে দেখা ইউনিট জানতে পারে, আগে সম্পর্ক ছিল এবং তা ভেঙে যাওয়ায় প্রতিশোধ নিতেই এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন এমন সংখ্যাই বেশি।
এ ক্ষেত্রে তারা সহজে সাইবার স্পেসকে ব্যবহার করছেন। অনেকে আবার ইন্টারনেটে নারীদের উত্যক্ত করাকে ‘স্টাইল’ মনে করেন। তাই তারা নারীদের ফেসবুক হ্যাক করে বন্ধুদের সঙ্গে ‘বিকৃত’ উল্লাস করেন। এছাড়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে অপরাধীরা নারীদের ইন্টারনেটে টার্গেট করছেন। এসব ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন তরুণী শিক্ষার্থীরা। সারাদেশের সবধরনের পরিবার ও স্তরের নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন।
এর কার্যক্রম সম্পর্কে ইউনিট প্রধান সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক (এআইজি) মীর আবু তৌহিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সাইবার জগতে নারীদের নিরাপদ রাখতে আমাদের এই বিশেষ ইউনিট। নারীরা যেন সাইবার অপরাধীদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি আমরা নিশ্চিত করব। প্রতিনিয়তই নারীদের প্রতি সাইবার অপরাধ বাড়ছে, আর আমরাও অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনি প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ইউনিটের কাজ শুধু অপরাধীদের শনাক্ত বা গ্রেফতার করা নয়, আমাদের সব থেকে বড় অংশ হচ্ছে ভিকটিমদের মানসিক কাউন্সেলিং করা। যাতে করে তারা যেন ডিপ্রেশনে (বিষাদগ্রস্ত) কোনো ধরনের ভুল না করে। এ জন্য আমাদের এই সাপোর্ট সেন্টারে অধিকাংশ কর্মকর্তা নারী। তাদের নারীদের সমস্যার সমাধান এবং কাউন্সেলিং দেবেন নারীরাই।’
গত বছরের ১৬ নভেম্বর রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আনুষ্ঠানিক এই ইউনিটের উদ্বোধন করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘নারী পুলিশ কর্মকর্তারাই এই ইউনিটে কাজ করবে। তারা সাইবার সংক্রান্ত অভিযোগের কল রিসিভ করবেন এবং ভুক্তভোগীকে তাৎক্ষণিক করণীয় ও সহায়তার পরামর্শ দেবেন।’
আইজিপি বলেন, ‘দেশ-কালের সীমা পেরিয়ে সাইবার অপরাধ সংঘটিত হয়। অপরাধীরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেইক আইডি খুলে অপরাধ করে থাকে। বাংলাদেশে এই সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে সংশ্লিষ্ট আইনে এখন পর্যন্ত ছয় হাজার ৯৯টি মামলা করা হয়েছে। এসব ঘটনার বেশিরভাগ ভুক্তভোগী নারী।’
এমএসি/এফআর
