বিদ্যুৎ জ্বালানিতে ‘আওয়ামী বোঝা’ ভোগাচ্ছে এখনও

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দুর্নীতি নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ ও সাশ্রয়ী পর্যায়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের প্রত্যাশা ছিল সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু এ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাসেও কাটেনি এই খাতের সংকট।
উল্টো বিগত সরকারের রেখে যাওয়া বকেয়ার ভার ও ক্যাপাসিটি চার্জে বেড়ে চলেছে আর্থিক বোঝা। এ খাতে বর্তমানে বকেয়ার পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা।
বিপুল বকেয়া!
গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে এখন বকেয়ার পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বকেয়া ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া গ্যাসে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) বকেয়া ২৭ হাজার কোটি টাকা।
আরও পড়ুন
বিপুল এই বকেয়ার কারণ হিসেবে এ খাতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, বড় প্রকল্প, অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকে দায়ী করা হয়।
পিডিবির তথ্যমতে, অসম সব চুক্তির ফলে বিগত সরকারের আমলে কেবল ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরও অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে বিপুল ক্যাপাসিটি চার্জ পূরণের ভার রয়েছে।
এদিকে বিগত সরকারের চুক্তি করা বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের (রামপাল, পায়রা, এস আলম) ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি। সে সময় এসব চুক্তি নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল। পরে যে বিশেষ বিধানের অধীনে চুক্তিগুলো করা হয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার তা বাতিল করেছে। এর পাশাপাশি এই বিধানের অধীনে চুক্তির আওতায় যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে, সেসব পর্যালোচনা করতে জাতীয় কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে কমিটির উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি।
আমদানিতেই ভরসা রাখছে সরকার
বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের চলমান আর্থিক সংকটের অন্যতম কারণ জ্বালানি আমদানি—বিশেষত এলএনজি। দেশীয় গ্যাসখাতে মনোযোগ দেওয়ার বদলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার বিপুল এলএনজি আমদানি করেছিল। জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারও একই পথে হাঁটছে।
বিগত অর্থবছরে গ্যাস খাতে ভর্তুকি ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থবছরে তার চাহিদা দেওয়া হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। স্পট মার্কেট বাড়ানো হয়েছে এলএনজি আমদানির পরিমাণ। অপরদিকে স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনেরও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন আমদানি নির্ভরতা জ্বালানি খাতের আর্থিক চাপকে কেবল বাড়িয়েই তুলবে।
বিদ্যুতেও চাপ
বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ১৪৩টি কিন্তু জ্বালানি সংকটে বন্ধ ও কারিগরি কারণে সক্ষমতার তুলনায় কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে প্রায় ৫০টি কেন্দ্র। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন কারণে বড় সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রায়ই ভরসা করতে হয় আমদানি করা বিদ্যুতের ওপর।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩১ হাজার মেগাওয়াট হলেও গড়ে ১১ থেকে ১২ হাজারের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। অদক্ষ ও অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসে থাকলেও মাসে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে।
এছাড়াও এ খাতে ভর্তুকির বড় অর্থ খরচ হয় গ্রাহক পর্যায়ে কম মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে। বর্তমানে কেন্দ্র পর্যায়ে ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ১২ টাকা, যা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা হয় ৮ টাকা ৪০ পয়সায়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, উৎপাদনে বিপিডিবির যথাযথ পরিকল্পনা থাকলে আরও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা গ্রাহকপর্যায়ে দেওয়া সম্ভব। এতে কমে আসবে ভর্তুকির চাপ।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে সক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত আর্থিক চাপে আছে। বিপুল অর্থ পাচার হওয়ায় বকেয়া পরিশোধে আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জ্বালানি সংকটসহ নানা কারণে উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। এছাড়া বর্তমানে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কেনা হয়। সে ক্ষেত্রে কয়লা, গ্যাস ও তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে কী দামে বিদ্যুৎ কেনা হবে, সে বিষয়ে একটি মানদণ্ড ঠিক করা হবে।
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা?
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে নেওয়া উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম—বিশেষ আইন বাতিল। এছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে নির্বাহী আদেশের ক্ষমতা বাতিল করে এই ক্ষমতা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ আইনের আওতায় করা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিভিন্ন চুক্তি পর্যালোচনা, এ খাতের কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান হিসেবে সচিবদের সরিয়ে দেওয়ার কাঠামোগত পরিবর্তনও আনা হয়েছে।
এছাড়া ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক বিদুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ পর্যালোচনা, সামিট গ্রুপের এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তি বাতিল করাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গ্যাস অনুসন্ধানে গ্রহণ করা ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনাও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার।
কিন্তু এ সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চাপ কমিয়ে সাশ্রয়ী, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে একটি জনস্বস্তিমূলক পরিস্থিতি তৈরি করা। সে প্রত্যাশার জায়গা কতটুকু পূরণ করা হয়েছে— এমন প্রশ্নে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি যে প্রত্যাশা রয়েছে, তা পূরণে জনগণের সহায়তা লাগবে। আমরা যদি গরমের মৌসুমে এসি ২৫ ডিগ্রিতে ব্যবহার করি তাহলে একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। এখন এসি যদি ১৯ ডিগ্রিতে ব্যবহার করি তাহলে বিদ্যুতের যে অপব্যয়টা হবে তার মাধ্যমে প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
আরও পড়ুন
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য কী?
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ ও জনগণের প্রত্যাশার বিষয়ে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, পরিবর্তন বলতে অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকটি বিষয়ের কথা বারবার বলছে। সেগুলো হচ্ছে- বিশেষ বিধান আইন বাতিল, মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির হাতে দেওয়া। আমি বলতে চাই, ক্ষমতা যদি বিইআরসির হাতে ফিরেই আসে তাহলে তার প্রতিফলন কোথায়? কাঠামোগত যে প্রক্রিয়াই গ্রহণ করা হোক না কেন, ন্যায্য মূল্য নির্ধারণের যে সক্ষমতা তা জ্বালানি বিভাগ ও তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আছে বলে আমার মনে হয় না। এর ফলে জনগণের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হবে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার এমন অনেক কিছুই করছে যা আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। সংস্কারের প্রশ্ন যদি বাদও দেই, তাহলে বলবো তাদের যে দায়িত্বটুকু সেটা তারা করুক, না পারলে কিছু করার দরকার নেই।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম কমানো হয়নি। যারা দুর্নীতি করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অ্যানালাইসিস না করেই বিগত সরকারের মতো এলএনজি আমদানি অব্যাহত রেখেছে, যা মোটেই প্রত্যাশাপূর্ণ নয়। এখন তারা যদি না পারে, তাহলে দায়িত্বটুকু পালন করে বলুক বাকিটা নির্বাচিত সরকার এসে করবে। কিন্তু যেটা চাওয়ার নয়, সেটা যেন না হয়।
ওএফএ/এমএসএ/এনএফ