ইঞ্জিনে নেই টয়লেট, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে ‘বিপদে’ পারাবতের চালক

প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া যেমন একজন মানুষের মৌলিক প্রয়োজন, তেমনি তা অনিবার্যও। কিন্তু ট্রেনচালকদের জন্য সেই প্রয়োজন মেটানোই যেন এক অপরাধে পরিণত হয়েছে। লোকোমোটিভে টয়লেট না থাকায় ট্রেন স্টেশনে রেখে ওয়াশরুমে যেতে বাধ্য হওয়ায় এক চালককে তলব করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয়েছে সমালোচনার ঝড়, প্রশ্ন উঠেছে ট্রেন চালকদের ন্যায্য অধিকার ও রেল প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।
জানা যায়, টয়লেটবিহীন ইঞ্জিনে দীর্ঘক্ষণ দায়িত্ব পালনকালে প্রকৃতির প্রয়োজনে সামান্য বিরতি নেওয়ায় সম্প্রতি ঢাকা-সিলেট রুটের আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেসের ২১ মিনিট বিলম্ব ঘটে। এই অপ্রত্যাশিত বিলম্বের জেরে কর্তব্যরত লোকোমোটিভ মাস্টার ও সহকারী লোকোমোটিভ মাস্টারকে তলব করেছে ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
একদিকে যেখানে ট্রেন চালকদের মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশায় কর্মরতদের মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণের সুযোগটুকুও রাখা হয়নি, সেখানে সামান্য বিলম্বের জন্য তাদের তলব করায় তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে যেসব লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) পরিচালিত হয়, সেগুলোতে নেই কোনো টয়লেট। কিন্তু প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়া প্রত্যেক মানুষের জন্য অত্যন্ত জরুরি এবং স্বাস্থ্যগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই মৌলিক প্রয়োজনটি চলন্ত অবস্থায় সময়মতো মেটাতে পারেন না লোকোমোটিভ মাস্টাররা। লোকোমোটিভে টয়লেট না থাকায় চালকদের অপেশাদার পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে, যা শুধু তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায় না বরং পুরো ট্রেন পরিচালনাকে অনিশ্চিত করে তোলে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আধুনিক বিশ্বে যেখানে নিরাপদ ও মানবিক কর্মপরিবেশ একটি স্বীকৃত মানদণ্ড, সেখানে বাংলাদেশের রেলওয়েতে এমন অব্যবস্থাপনা শুধু কর্মীদের প্রতি অবহেলারই প্রতিচ্ছবি নয়, বরং নিরাপদ রেল চলাচল ব্যবস্থার ওপরও এক বড় হুমকি। কর্তৃপক্ষের উচিত বিষয়টির মানবিক দিক বিবেচনা করে দ্রুত প্রতিটি ইঞ্জিনে টয়লেট স্থাপনের ব্যবস্থা করা এবং চালকদের জন্য একটি সহনীয় কর্মপরিবেশ তৈরি করা, যা যাত্রী ও ট্রেন উভয়ের নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য।
ইঞ্জিনে টয়লেট থাকা একটি ন্যায়সংগত দাবি
এদিকে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। জুলহাস উদ্দিন নামে একজন লিখেছেন, ইঞ্জিনে টয়লেট থাকা একটি ন্যায়সংগত দাবি। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ সেই ব্যবস্থা রাখেননি। সামনের ব্রেক তালাবদ্ধ না রাখলে বিনা টিকিটের যাত্রীসহ যে কেউ প্রবেশ করতে পারে। ঝুঁকি এড়াতে তালা দিয়ে রাখা হয়। গার্ড সাহেবের ডিটেনশনও ঠিক আছে, তিনি তো মিথ্যা লেখেননি।
রিফাত খান নামের আরেকজন মন্তব্য করেন, প্রতিদিন দায়সারা কন্ট্রোলিংয়ের কারণে বিভিন্ন ট্রেন অকারণে বসিয়ে রাখা হয়, ফলে লেট বেড়েই যায়। এর জন্য কোনোদিন কোনো কন্ট্রোলারকে তলব করতে দেখি না।
মাসুম এলএম নামে একজন লিখেছেন, দুঃখজনক ঘটনা। লোকোমোটিভের সঙ্গে গার্ডব্রেক এলএম দায়িত্বে থাকলে এই বিড়ম্বনা হতো না। ইঞ্জিনে টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকলেও ডিআরএম মহোদয় এই বিষয়ে অর্ডার দিতে পারেন। আমি মনে করি, লোকোমাস্টারদের প্রতি প্রশাসনের চরম অবহেলা রয়েছে। সমস্যার সমাধান কর্তৃপক্ষ চাইলে সহজেই করতে পারে। আশাবাদী, সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রেন চালকদের কাজ অত্যন্ত চাপপূর্ণ (স্ট্রেসফুল)। এর মধ্যে যদি প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার সুযোগ না থাকে, তবে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। এতে শারীরিক অস্বস্তির পাশাপাশি মানসিক চাপও বেড়ে যায়, যা সরাসরি চালনার দক্ষতায় প্রভাব ফেলতে পারে। তাই ট্রেন চালকদের এই স্ট্রেস কমাতে রেল কর্তৃপক্ষকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে ভবিষ্যতে যেসব লোকোমোটিভ আমদানি করা হবে, সেগুলোর ডিজাইনে যেন টয়লেট সুবিধা বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত থাকে।
সেদিন কী ঘটেছিল
গত ১৭ মে ভোর সাড়ে ৬টায় ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস (৭০৯)। এই ট্রেনটি চালাচ্ছিলেন লোকোমোটিভ মাস্টার মো. আবদুর রহমান এবং সহকারী লোকোমোটিভ মাস্টার কাউছার আহম্মেদ।
আবদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে জানান, ট্রেনটি নিয়ে সকাল ৮টা ৪৪ মিনিটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে দাঁড়াই। তার কিছু আগে থেকেই প্রাকৃতিক ডাক অনুভব করছিলাম। ট্রেনটি স্টেশনে দাঁড় করানোর পরপরই ইঞ্জিনের পেছনে থাকা ট্রেনের গার্ডরুমে যাই। সেখানে তালা মারা দেখতে পেয়ে গার্ডকে ফোন করি। তাকে বলি, চাবিটি তো খাবার গাড়ি ম্যানেজারের কাছে দিয়ে গেলেও পারতেন, তাহলে আমরা টয়লেট ব্যবহার করতে পারতাম। তিনি জবাব দেন, এটা তো বন্ধ থাকারই কথা। এরপর আমি আর কথা না বাড়িয়ে বলি যে স্টেশন মাস্টারের টয়লেট ব্যবহার করতে যাচ্ছি। তিনি সম্মতি দেন। বিষয়টি আমি ঢাকা কন্ট্রোলেও জানাই।
আরও পড়ুন
তিনি আরও বলেন, পেছনে তখন চট্টগ্রামগামী ননস্টপ আন্তঃনগর ট্রেন সোনারবাংলা এক্সপ্রেস (৭৮৮) থাকায় সেটিকে আগে যাওয়ার জন্য সিগন্যাল দেওয়া হয়। আমার ওয়াশরুমে যাওয়া-আসাসহ মোট ছয় মিনিট সময় লাগে। ৭৮৮-কে অগ্রাধিকার দেওয়া ও ওয়াশরুম ব্যবহারে মোট ২১ মিনিট সময় লেগেছে। গার্ড সাহেব তার ডিটেনশন বইতে সেটিই লিখেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দুজনকে আগামীকাল মঙ্গলবার (২০ মে) সকাল ৯টায় ডিআরএম দপ্তরে হাজির হতে বলা হয়েছে।
গত ১৮ মে ঢাকা লোকোশেডের বিভাগীয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এক নির্দেশনায় লিখেছেন, ১৭ মে ৭০৯ নম্বর ট্রেনে কর্মরত লোকোমাস্টার মো. আবদুর রহমান এবং সহকারী কাউছার আহম্মেদকে ২০ মে সকাল ৯টায় ডিআরএম ঢাকা অফিসে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হলো।
প্রতিটি ইঞ্জিনে বায়ো-টয়লেটের দাবি লোকোমাস্টারদের
বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা কখনোই সময়মতো প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে পারি না। এর ফলে আমাদের লোকোমাস্টাররা নানা শারীরিক জটিলতায় পড়েন। অনেকের অবসরের পর কিডনি ও মূত্রনালির সমস্যা দেখা দেয়।
তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে প্রতিটি লোকোমোটিভে বায়ো-টয়লেট থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে যারা ইঞ্জিন আমদানি করে তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই তা বাদ রাখে। এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা। এটি আমাদের মৌলিক অধিকার। আমরা কখনোই ইচ্ছা করে ট্রেন থামিয়ে টয়লেটে বসে থাকি না। প্রতিটি ইঞ্জিনে বায়ো-টয়লেট থাকা অত্যাবশ্যক। আমরা প্রতিটি ইঞ্জিনে বায়ো-টয়লেট দাবি করছি।
আরও পড়ুন
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রেন চালকদের কাজ অত্যন্ত স্ট্রেসফুল। এর মধ্যে যদি প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার সুযোগ না থাকে, তাহলে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। এতে কাজে মনোযোগও কমে যেতে পারে।
তিনি বলেন, লোকবল ঘাটতি বা ওয়াশরুম পরিষ্কারের অজুহাত দিয়ে এ অধিকার কেড়ে নেওয়া অনুচিত। পুরো ট্রেনের নিরাপত্তা ও যাত্রীদের জীবন রক্ষার দায়িত্ব যাদের হাতে, তাদের প্রতি এমন অবহেলা পুরো সিস্টেমকে ঝুঁকিতে ফেলছে। উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের ভবিষ্যৎ লোকোমোটিভগুলোর স্পেসিফিকেশনে অবশ্যই টয়লেট থাকতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকা বিভাগের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আরিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি ট্রেন লেট হয়েছিল। ট্রেনের যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ডাকা হয়েছে। তারা টয়লেটে গিয়েছিলেন কি না, তা আমরা জানি না। আমরা শুধু জানি ট্রেনটি দেরি করেছে। তাই সংশ্লিষ্টদের ডেকে জানতে চাওয়া হয়েছে, কী কারণে দেরি হয়েছে।
এমএইচএন/এমজে
