ভোগান্তিতে বিপর্যস্ত জনজীবন, যানজট কমাতে গলদঘর্ম ট্রাফিক পুলিশ

ফার্মগেট হলিক্রসের গলিতে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। সামনে পিছে গাড়ি আর গাড়ি। হর্ন তো অনবরত বাজছেই। অনেক কষ্টে মেয়েকে রিসিভ করে রিকশায় ওঠেন মা জাহানারা বেগম (ছদ্মনাম)। তখন বেলা সাড়ে ১২টা। এরপর থেকে যেন ভোগান্তির শুরু। সেখান থেকে দেড় ঘণ্টায় তিনি তেজগাঁও রেলগেট, ট্রাক স্ট্যান্ড পেরিয়ে সাতরাস্তা মোড়ে গিয়ে পৌঁছান। সেখানে আটকে থাকার সময় যেন দীর্ঘই হচ্ছিল, কারণ সিগন্যাল ছাড়ছিল না।
ত্যক্ত-বিরক্ত ওই অভিভাবক দুপুর পৌনে ২টার দিকে ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটাই এখন ঢাকাবাসীর নিয়তি। এভাবেই প্রতিদিন মেয়েকে নিয়ে সপ্তাহের অন্তত ৩/৪ দিন ভুগতে ভুগতে ফিরতে হয় বাসায়। জনজীবন ভোগান্তিতে পড়লেও দেখার বা শোনার যেন কেউ নেই।
ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, চরম ভোগান্তিতে বিপর্যস্ত জনজীবন, যানজট কমাতে গলদঘর্ম ট্রাফিক পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা। কোনো কৌশলই যেন কাজে আসছে না। জনভোগান্তির কারণ যানজট বলা হলেও যানজটের নেপথ্যের কারণ ঢাকার ৩/৪টি স্থানে আন্দোলন।
ট্রাফিক পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনের শপথের দাবিতে মৎস্যভবন ও কাকরাইল মোড়ে যানচলাচল বন্ধ করে দেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। ঢাবি ছাত্র সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনে ছাত্রদল নেতাকর্মীরা। স্বাভাবিকভাবে কাকরাইলগামী সড়ক, বাংলামোটর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত দুই সড়কেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এর বাইরে মিন্টো রোডে ভিআইপিদের বাসা ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনাগামী সড়কে চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। সব মিলে আজ সপ্তাহের শেষ দিনটার ঢাকার জন্য চরম ভোগান্তির হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাকরাইল মোড়ে কথা হয় সিএনজি চালক তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে। ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে তিনি বলেন, বসুন্ধরা এলাকা থেকে আসছি। যাবো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মিটারের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, আমি যখন মগবাজার তখন পর্যন্ত সময় লেগেছে ৫৫ মিনিট। আর মগবাজার ফ্লাইওভার থেকে নেমে কাকরাইল পর্যন্ত লেগে গেছে সোয়া ঘণ্টা। এই অবস্থায় মানুষ যাবে কোথায়? দিনের চালানের টাকাই তো আজ উঠবে না।
মোটরসাইকেলের পাঠাও চালক আবু জাফর ঢাকা পোস্টকে পাঠাও অ্যাপসের ম্যাপের রুট দেখিয়ে দিনের ভয়াবহ ভোগান্তির কথা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আগারগাঁও থেকে উড়োজাহাজ ক্রসিং মোড়ে আসার পর দেখি বিজয় সরণি সিগন্যালগামী সড়কে তীব্র চাপ। রুট চেঞ্জ করে খামারবাড়ির দিকে যেতেই বুঝতে পারলাম ভোগান্তি আছে। এরপর অনেক কষ্টে ফার্মগেট, এরপর কারওয়ান বাজারগামী সড়কে যেন গাড়ি নড়ছিলই না। আবারো রুট চেঞ্জ করে ঢুকে পড়ি তেজগাঁও রেলগেটের সড়কে। রেলগেট পর্যন্ত যেতে পারি স্বস্তিতে। এরপর আবার শুরু যানজটের। ট্রাক স্ট্যান্ড থেকে সাতরাস্তা মোড় পেরিয়ে মগবাজার ফ্লাইওভার হয়ে মিন্টো রোড পৌঁছাতে সব মিলিয়ে আড়াই ঘণ্টা। চারদিকে যানবাহনের চাপ। মিন্টো রোড দিয়ে ঢুকতে গিয়ে দেখি ট্রাফিক ডাইভারশন। ঢুকতে দিচ্ছে না পুলিশ। পুলিশ কারণ জানায় সামনে আন্দোলনের কারণে সড়কে চলাচল বন্ধ। বন্ধ রমনা পার্ক ঘেঁষে কাকরাইলগামী লেনও। বাধ্য হয়ে এবার সোজা পথেই রওনা দেই। মিন্টো রোড থেকে কাকরাইল পৌঁছাতে আরও আধা ঘণ্টা। এটা তো আমার দুর্ভোগের বিবরণ। যারা তিন বা চার চাকায় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন তাদের অবস্থাটা ভাবেন।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে সরেজমিনে দেখা যায়, বিজিবি, র্যাব, ডিবি পুলিশ, থানা পুলিশ, আনসারের বিপুল সংখ্যক সদস্য মোতায়েন। চলাচল বন্ধ সামনে পেছনের সব সড়কে। সামনে আন্দোলন-বিক্ষোভে সড়ক উত্তাল করে রেখেছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।
সেখানে কথা হয় ব্যারাক থেকে আন্দোলনের সামনে ডিউটিরত এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে। তিনি নাম প্রকাশ না করে বলেন, সেই সকালে আসছি। বেলা ১১টার পর থেকে এই এলাকায় ঘুরছে না গাড়ির চাকা। বিক্ষোভ স্লোগান অনবরত চলছে। মানুষ আসছে, নামছে, হেঁটে গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। মানুষের ভোগান্তি দেখে শুধু খারাপই লাগছে, কিন্তু কিছুই যেন করার নেই।
কাকরাইল মোড়ে কথা হয় ট্রাফিক পুলিশ সদস্য মতিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, মৎস্যভবন ও কাকরাইল মোড়ে আন্দোলনের অবস্থা বুঝে সড়কে চলাচল ডাইভারশন করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সড়কে ভুগতে থাকা মানুষকে খুবই ক্লান্ত বিরক্ত মনে হচ্ছে। কেউ কথা শুনছেন না। ডাইভারশন মানতে চাইছেন না। যে যার মতো উল্টাপাল্টা চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এতে করে যানজট আরও বেশি বেঁধে যাচ্ছে।
প্রাইভেটকার চালক আনিসুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফার্মগেট থেকে বের হয়েছি। ৩ ঘণ্টাতেও মতিঝিল পৌঁছাতে পারিনি। কারওয়ান বাজার আসার পর এফডিসি রোডে ঢুকছি। এরপর মগবাজার হয়ে যানজট ঠেলতে ঠেলতে কাকরাইল। এখানে আরও বেশি চাপ। এভাবে ঢাকা শহরে চলাচল খুবই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। সবাই যেন আন্দোলনে দাবি আদায়ের শহর মনে করছে ঢাকাকে।
রমনা ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) শফিকুল ইসলাম বলেন, আজকে সপ্তাহের শেষ দিন। এমনিতেই চাপ বেশি থাকে। তারমধ্যে আজকে রমনার তিন স্পটে ব্লক। নিরাপত্তার কারণে কোথাও যানচলাচল বন্ধ। কোথাও আবার ডাইভারশন দেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে খুবই নাজুক অবস্থা আজ সড়কে। মানুষের ভোগান্তি আজ বর্ণনাতীত। ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা যেন কোনো কাজে আসছে না।
তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) রফিকুল ইসলাম ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়’ বিখ্যাত সেই প্রবচন মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, রমনা এলাকায় আজকে কলাপস করেছে। রমনা, পল্টন, গুলিস্তান, মতিঝিলের দিকে যারা যান, তাদের অধিকাংশই তেজগাঁও এলাকার সড়ক ব্যবহার করেন। রমনার ৩৪টা স্থানের মোড় ও সড়ক দিয়ে যানচলাচল বন্ধ আন্দোলনের কারণে। যার বড় চাপটা সামলাতে হচ্ছে তেজগাঁও বিভাগকেই। ওদিকে তো গাড়ি বের করাই কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। আমাদেরকে ডাইভারশন করতে হচ্ছে। অলিগলি সবখানে যানজট। এরমধ্যে আবার অফিসফেরত যাত্রা শুরু হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমার ট্রাফিক সদস্যরা গলদঘর্ম হয়ে সড়কে পড়ে আছেন। চেষ্টার কোনো ত্রুটি যেমন নেই, তেমনি আর উপায়ও যেন নেই। সব উপায় ব্যবহারেও কমানো যাচ্ছে না মানুষের যানজট দুর্ভোগ।
জেইউ/জেডএস