প্রান্তিক জেলেদের জন্য পূর্ব সতর্কতা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি

প্রান্তিক জেলেদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পূর্ব সতর্কতা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। তথ্যের অভাবে যাতে প্রাণহানি না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হবে।
গভীর সমুদ্রগামী জেলেদের দুর্যোগ প্রস্তুতি ও প্রাণহানি হ্রাসে সহায়তা করার লক্ষ্যে ‘গভীর সমুদ্রগামী জেলেদের জন্য প্রাথমিক সতর্কবার্তা সরবরাহে ভিএইচএফ রেডিও নেটওয়ার্কের সক্ষমতা মূল্যায়ন বিষয়ক মাঠ পর্যায়ের ফলাফল শেয়ারিং’ শীর্ষক এক জাতীয় কর্মশালায় এ কথা বলেন বক্তারা।
বৃহস্পতিবার (২৯ মে) রাজধানীর মহাখালীর বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল অবকাশে ‘ভিএইচএফ রেডিও নেটওয়ার্ক’ ব্যবহারে জেলেদের জন্য আগাম বার্তা পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা বিষয়ে এ জাতীয় কর্মশালার আয়োজন করা হয়।
অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট হাঙ্গার বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর তপন কুমার চক্রবর্তী বলেন, এ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো গভীর সমুদ্রে অবস্থানরত জেলেদের জন্য নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর শেষ মাইল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে তারা সময়মতো ও কার্যকর সতর্কবার্তা পেতে পারে। এটি কেবল ঘূর্ণিঝড় প্রতিক্রিয়ার জন্য নয়, বরং সামগ্রিকভাবে সামুদ্রিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি সরকার, কমিউনিটি ও কারিগরি খাতের অংশীদারদের ধন্যবাদ জানান এবং বলেন, আমাদের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন-সমুদ্রে জীবন বিপন্ন করে কাজ করা জেলেদের সুরক্ষা ও তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে কলাপাড়ার জেলে মো. সিদ্দিক মাঝি জানান, পূর্ব সতর্কতা না পাওয়ায় তিনি ২০ জন সহযাত্রীসহ আট ঘণ্টা পানিতে কাটিয়েছেন এবং পরবর্তীতে পাঁচ দিন পর সুন্দরবন থেকে উদ্ধার হন।
আরও পড়ুন

তিনি বলেন, অধিকাংশ সময়ই নেটওয়ার্কের বাইরে থাকি। কুয়াকাটা উপকূলীয় এলাকা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং যদি জেলেরা পূর্ব সতর্কতা পায় তবে তারা জলদস্যু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে। আমরা কিন্তু খুব সহজেই ‘ভিএইচএফ রেডিও নেটওয়ার্ক’ ব্যবহার করে খবরাখবর নিতে ও দিতে পারব। এজন্য তিনি দ্রুত এটি বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে অংশীজন হিসেবে উপস্থিত বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের উপপরিচালক (অপারেশনস) কমান্ডার সাজ্জাদ রায়হান বলেন, এটা যুগান্তকারী উদ্যোগ। ‘ভিএইচএফ রেডিও নেটওয়ার্ক’ মেইনটেইন করাটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা যদি মেইনটেইন করা না যায় তাহলে এর লক্ষ্য পূরণ হবে না। এক্ষেত্রে কোস্ট গার্ড সহযোগিতা করতে পারে। ভিএইচএফ রিপিটার স্টেশন রক্ষণাবেক্ষণে কোস্ট গার্ডের সক্ষমতা রয়েছে।
তবে তিনি বলেন, এটা ব্যবহারের কিছু নিয়মকানুন আছে। সেটাও জানতে হবে। নিয়ম না জানলেও এটা ব্যবহারে উল্টো ফল দেবে। ঝড়ের সময় তো এমনিতেই রেডিও বার্তা ক্লিয়ার শোনা যায় না।
উদাহরণ দিয়ে সাজ্জাদ রায়হান বলেন, আমাদের দুটি ফিশার বোট ইন্ডিয়া নৌ-সীমা পেরিয়ে ঢুকে পড়েছিল। তখন কিন্তু তাদের উদ্ধার করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। আবার ‘ভিএইচএফ রেডিও নেটওয়ার্ক’ ব্যবহারকারী সবাই যে ভালো হবে তা ভাবার কারণ নেই। এটার অপব্যবহারে ডাকাতির ঘটনাও ঘটতে পারে। সেদিকটাও খেয়াল রাখার আহ্বান জানান তিনি।
তিনি জাহাজ ট্র্যাকিংয়ের জন্য এআইএস ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং পরিবেশগত পরিস্থিতি অনুযায়ী ফ্রিকোয়েন্সি সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
নৌযান মালিক মো. ফজলু গাজী জানান, একটি ট্রলার ব্যবসা শুরু করতে কমপক্ষে এক কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। ভিএইচএফ প্রযুক্তি অগ্রিম যোগাযোগে সহায়তা করতে পারে, যা দুর্যোগের সময় জেলেদের নিরাপদে ঘাটে ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক এবং কর্মশালার সঞ্চালক নিতাই দে সরকার উল্লেখ করেন, ‘স্টারলিংক’ নামক নতুন প্রযুক্তি কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হলে এটি পূর্ব সতর্কতা ব্যবস্থায় আরও ফলপ্রসূ হবে। কার্যকর পূর্ব সতর্কতা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) পরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব আহমাদুল হক বলেন, এই পাইলট কার্যক্রম ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত সমুদ্রে পূর্বাভাস পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে এবং সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই পরিসীমা ১৫০ কিলোমিটার বা তার বেশি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা সম্ভব। তিনি সব সমুদ্রগামী জাহাজে ভিএইচএফ রেডিও ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং এই পাইলট সফল করতে সরকারের সঙ্গে এনজিওগুলোর দৃঢ় সহযোগিতার প্রশংসা করেন।
তিনি আরও বলেন, যদি এই কার্যক্রমকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে সমগ্র বঙ্গোপসাগর কভার করা সম্ভব এবং বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে।
মোডিএমআর-এর অতিরিক্ত সচিব ও FbF/A টাস্ক ফোর্সের চেয়ারপারসন কে এম আবদুল ওয়াদুদ প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, এই পাইলট প্রকল্পটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা নিশ্চিত করবে যেন দুর্যোগ প্রস্তুতির কোনো পর্যায়েই কেউ পিছিয়ে না থাকে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান কর্মশালায় সভাপতির বক্তব্যে বলেন, প্রান্তিক জেলেদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পূর্ব সতর্কতা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। তথ্যের অভাবে যাতে প্রাণহানি না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি), বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বিটিসিএল, মৎস্য অধিদপ্তর, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং গণমাধ্যমের সিনিয়র প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
কর্মশালায় জোরালোভাবে সুপারিশ করা হয় যে, জীবন রক্ষাকারী এই তথ্য যেন ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর কাছে সময়মতো পৌঁছায় তা নিশ্চিত করতে জাতীয় কাঠামোর আওতায় ভিএইচএফ-ভিত্তিক পূর্ব সতর্কতা ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হোক।
জেইউ/এসএসএইচ