টিউশনির উপার্জনে পড়ালেখা করা নিখিল এখন মাইক্রোসফটে

মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছে। বাধ্য হয়ে সন্তানকে বড় করতে মাকে নিতে হয় চাকরি। কিন্তু গার্মেন্টসের চাকরির সামান্য টাকায় কোনো রকম সংসার চললেও ছেলের পড়াশোনার খরচ ওঠে না। নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় শুরু করে টিউশনি। সেই টিউশনি করেই স্কুল-কলেজ পেরিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।
এরপর একদিন সুযোগ আসে স্কলারশিপ নিয়ে ফিনল্যান্ড যাওয়ার…। টিউশনি করে করে জীবন চালানো চট্টগ্রামের জেলেপাড়ার নিখিল দাশ এখন কাজ করছেন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটে!
নিখিল দাশ চট্টগ্রামের কাটগড় মুসলিমাবাদ জেলেপাড়ার বাসিন্দা নিরাঞ্জন জলদাশ ও কমলা দাশের একমাত্র সন্তান। পতেঙ্গা ইস্টার্ন রিফাইনারি মডেল হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর নিখিল চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। পরে সেখান থেকে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে। সেখান থেকে ২০১৫ সালে স্নাতক ও ২০১৭ সালে স্নাতকোত্তর শেষে স্কলারশিপ নিয়ে পাড়িজমান ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ডে। ফিনল্যান্ডের টেমপেরে (Tampere) ইউনিভার্সিটিতে পদার্থ বিজ্ঞানে মাস্টার্সে পড়াশোনা করেন তিনি। ২০২১ সালের এপ্রিলে নিখিল ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকির এসপো সিটিতে মাইক্রোসফটের অফিসে ল্যাব ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
নিখিল ঢাকা পোস্টকে জানালেন তার সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠার কথা। ইতোমধ্যে তিনি মাইক্রোসফটে ল্যাব ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দিয়েছেন। নিখিল বলেন, ছোট বেলায় বাবা মারা যান। আমার মা একটি এনজিওতে অল্প বেতনে চাকরি করতেন। তা দিয়ে সংসার চালাতে হতো। নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থা থেকে টিউশনি শুরু করেছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময়ও টিউশনি করেছি। আমাকে পড়াশুনা করাতে মা অনেক কষ্ট করেছেন।
ছোট বেলা থেকেই বড় কোম্পানিতে চাকরি করার ইচ্ছা ছিল নিখিলের। সেই ইচ্ছা শক্তিই হয়তো তাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।
‘আমার সরকারি চাকরি করার ইচ্ছে ছিল না। যে কারণে স্নাতকোত্তর পড়া শেষে কিছুদিন দেশের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছি। এর পাশাপাশি দেশে বাইরে যেতে স্কলারশিপের জন্য চেষ্টা করতে থাকি। স্কলারশিপও পেয়ে যাই জার্মান ও ফিনল্যান্ডে। পরে ২০১৮ সালে ফিনল্যাডে স্কলারশিপ করার জন্য আসি। মাইক্রোসফটে চাকরি হওয়ার আগে আমি এখানে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করি।’
চট্টগ্রামের ছেলে নিখিল দাশ বলেন, বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের পরিধি অনেক বড়। এখানে কাজ করতে পারাটা গর্বের। মনে হচ্ছে আমার মেধার পুরোটাই দিতে পারবো। আমি সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করব, যাতে দেশের সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে পারি।
নিখিল তরুণদের উদ্দেশে বলেন, স্বপ্ন দেখলে বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। লেগে থাকলে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। লক্ষ্য ঠিক থাকলে তা পূরণ হবেই। হতাশ হলে চলবে না। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত লেগে থাকতে হবে।
একমাত্র ছেলের এমন সাফল্যে দারুন খুশি নিখিলের মা কমলা দাশ। ঢাকা পোস্টকে কমলা দাশ বলেন, নিখিলের বয়স যখন সাড়ে তিন বছর তখন তার বাবা মারা যান। এরপর আমি কিছুদিন একটা পোশাক কারখানায় কাজ করি। এরপর ৬০০ টাকা বেতনে একটি এনজিওর চাকরি করেছি। এর পাশাপাশি টিউশনিও করেছি। নিখিলের পড়াশুনা চলানো এবং সংসার চলাতে তা করতে হতো।
তিনি বলেন, আমাদের একটি চায়ের দোকান ছিল। সেখানে নিখিল অন্যদের সঙ্গে কাজ করত। আমার ছেলে অনেক কষ্ট করেছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশুনা করে এসেও দোকানদারি করত। নিখিল ক্লাস নাইন থেকেই টিউশনি শুরু করে। টিউশনি করে নিজের খরচ নিজে চালানোর চেষ্টা করেছে।
নিখিলের মা বলেন, অনেক কষ্টে নিখিলকে আমি এখানে আনতে পেরেছি। তাকে ভালো জিনিস খাওয়াতে-পরাতে পারিনি। এতোদূর যে আনতে পারবো তা কখনও কল্পনা করি নাই।
নিখিল এখন ভালো পজিশনে চাকরি করে, এতেই আমি অনেক খুশি নিখিলের মা। ‘কি খুশি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। দুনিয়াতে আমার থেকে কেউ খুশি হয় নাই। এতে আমার গৌরব লাগছে।’
তিনি আরও বলেন, হয়তবা একসময় কষ্টে ছিলাম। এজন্য হয়তো খোদা এখন মুখ তুলে তাকিয়েছেন। আমার জানা মতে, জেলে পাড়া থেকে নিখিলের আগে কেউ দেশের বাইরে চাকরি করেনি। এটা আমার জন্য গৌরবের।
কেএম/এসএম
