অর্থনীতির স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যের অর্থনীতি

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে নানা সমস্যায় জর্জরিত, যেমন অপ্রতুল বিনিয়োগ, উচ্চ ব্যক্তিগত ব্যয় এবং অসম স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ অনেক স্বাস্থ্য সূচকে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এখনও স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান এবং নাগরিকদের ওপর অর্থনৈতিক চাপকে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক স্বাস্থ্য বাজেটের প্রবণতা, ব্যক্তিগত ব্যয়ের প্রভাব, অর্থনীতির ওপর এর বিস্তৃত প্রভাব এবং একটি সমতাভিত্তিক ও শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গঠনের জন্য নীতিগত পরামর্শ এই প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে নানা সমস্যায় জর্জরিত, যেমন অপ্রতুল বিনিয়োগ, উচ্চ ব্যক্তিগত ব্যয় এবং অসম স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ অনেক স্বাস্থ্য সূচকে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এখনও স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান এবং নাগরিকদের ওপর অর্থনৈতিক চাপকে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক স্বাস্থ্য বাজেটের প্রবণতা, ব্যক্তিগত ব্যয়ের প্রভাব, অর্থনীতির ওপর এর বিস্তৃত প্রভাব এবং একটি সমতাভিত্তিক ও শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গঠনের জন্য নীতিগত পরামর্শ এই প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বাজেট সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নামমাত্র বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু মোট বাজেটের অংশ খুব কমই পরিবর্তিত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই বরাদ্দ সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮ হাজার ০৫২ কোটি টাকা হয়েছে, আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের প্রথম বাজেটে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য স্বাস্থ্য খাতে ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটি ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মাত্র ৫০১ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। বরাদ্দ তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল, যা ৫.২% থেকে সামান্য বেড়ে ৫.৩% হয়েছে। নামমাত্র বৃদ্ধি সত্ত্বেও, স্বাস্থ্য বাজেটের জিডিপির অংশ ০.৭৪% থেকে কমে ০.৬৬% হয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে স্বাস্থ্য খাতের বৃদ্ধি সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রসারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি।
অবশ্য বাংলাদেশের সীমিত আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও, কিছু স্বাস্থ্য সূচকে অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। মাতৃমৃত্যুর হার ২০০৭ সালে প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মে ৩৫১ থেকে নেমে ১৩৬-তে এসেছে। একইভাবে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু প্রতি ১ হাজার জনে ৬০ থেকে কমে ৩৩ হয়েছে এবং গড় আয়ু ২০০৭ সালে ৬৬.৬ থেকে বেড়ে এখন ৭২.৩ হয়েছে। এই উন্নতিগুলো ইমিউনাইজেশন কর্মসূচি, কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা এবং স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের মতো কার্যকর গণস্বাস্থ্য উদ্যোগের ফল।
আরও পড়ুন
তবে, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে আরও অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উচ্চ ব্যক্তিগত ব্যয় রোগীদের সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত রাখছে, যার ফলে চিকিৎসায় বিলম্ব হচ্ছে এবং রোগ আরও গুরুতর হয়ে পড়ছে। ফলে গত ১০ বছরের অগ্রগতিও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে যদি আর্থিক সমস্যাগুলো সমাধান না করা হয়।
স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিনিয়োগ একটি অপরিহার্য বিনিয়োগ, কারণ এটি জীবন বাঁচায় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। একটি সুস্থ জনগোষ্ঠী বেশি উৎপাদন করতে পারে, কম কাজ হারায় এবং জাতীয় উৎপাদনে অবদান রাখে। বিপরীতে, স্বাস্থ্য খাতে অপ্রতুল বিনিয়োগ উৎপাদনশীলতার ক্ষতি, অসমতা বৃদ্ধি এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে বাধা তৈরি করে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা খাত, বিশেষ করে ওষুধ শিল্প, একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। বর্তমানে, বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরীণ ওষুধের চাহিদার ৯৮ শতাংশেরও বেশি পূরণ করে এবং ১০৭টিরও বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে। এই খাত জিডিপি বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, এই শিল্পগুলোকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হলে স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ ব্যবস্থায় সমানভাবে বিনিয়োগ করতে হবে। না হলে এই খাত নানাবিধ সমস্যায় পড়তে পারে। এছাড়া, মহামারি পরিস্থিতির মতো জনস্বাস্থ্য সংকটগুলো দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে অর্থনীতিকে দ্রুত ধ্বংস করে দিতে পারে, যেমনটি কোভিড-১৯ সংকটে দেখা গেছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এখনও কিছু কাঠামোগত ও কার্যকরী সমস্যা বিরাজমান। একটি বড় সমস্যা হলো বাজেটে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় না হওয়া, অপব্যবহার বা অপ্রয়োগ হওয়া। দুর্বল বাস্তবায়ন ক্ষমতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে প্রতি বছর স্বাস্থ্য বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অব্যয়িত থেকে যায়। অথচ গ্রামীণ এলাকায় অবকাঠামো প্রায়ই অনুন্নত, দুর্বল এবং অনেক কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাব রয়েছে। প্রতি ১০ হাজার জনের জন্য মাত্র ৭ জন ডাক্তার রয়েছে, যা WHO-এর প্রস্তাবিত ২৩ জনের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া, শহর ও গ্রামের স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়ে গেছে; গ্রামীণ এলাকায় বিশেষায়িত সেবা ও প্রশিক্ষিত জনবল পাওয়া কঠিন।
দ্বিতীয় বড় সমস্যা হলো স্বাস্থ্য বিমার অভাব। অনেক দেশ যেখানে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা জাতীয় স্বাস্থ্য বিমা ব্যবস্থা চালু করেছে, সেখানে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যয়ের পুরো চাপ সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে, যার ফলে স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকারে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে আরও সমতাভিত্তিক এবং টেকসই স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ প্রয়োজন। স্বাস্থ্যের পুনর্গঠনের জন্য এইরকম গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে।
প্রথমত, সরকারকে ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য বাজেট বাড়িয়ে WHO-এর সুপারিশ অনুযায়ী জিডিপির ন্যূনতম ৫% করতে হবে যাতে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার জন্য দরকারি তহবিল নিশ্চিত হয়। দ্বিতীয়ত, একটি সরকারি অর্থায়িত জাতীয় স্বাস্থ্য বিমা স্কিম বা কমিউনিটি-ভিত্তিক স্বাস্থ্য অর্থায়ন মডেল প্রসারিত করার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ব্যয়ের বোঝা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে, গ্রামীণ এলাকাগুলোতে চিকিৎসক, ডায়াগনস্টিক সুবিধা ও টেলিমেডিসিনের সুযোগ বাড়িয়ে স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো ও মানবসম্পদে বিনিয়োগ করতে হবে।
চতুর্থত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং পরিকল্পনাভিত্তিক দক্ষতা বাড়িয়ে বাজেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রান্তিক জনগণের কাছে পৌঁছানো এবং ডিজিটাল হেলথ টেকনোলজি ব্যবহারে উদ্ভাবনী কৌশল বাস্তবায়ন জরুরি। স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে দেশব্যাপী প্রচারণা চালানো উচিত যাতে রোগ নির্ণয়, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও চিকিৎসা বিষয়ে জনগণকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করা যায়।
বাংলাদেশ অল্প বিনিয়োগে স্বাস্থ্যসেবায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, কিন্তু উচ্চ ব্যক্তিগত ব্যয় এবং অপ্রতুল তহবিলের কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে। স্বাস্থ্য বাজেট যদিও বাড়ছে, কিন্তু জিডিপি এবং জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায় তা নগণ্য। এর ফলে উৎপাদনশীলতা হ্রাস, দারিদ্র্য বৃদ্ধি এবং আর্থিক বৈষম্যের মতো গুরুতর অর্থনৈতিক প্রভাব দেখা দিচ্ছে। সরকারকে স্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে, বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে, কার্যকরভাবে ব্যয় করতে হবে এবং জাতীয় স্বাস্থ্য বিমার মতো আর্থিক সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। একটি সঠিকভাবে অর্থায়িত এবং পরিচালিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি সঠিক বিনিয়োগ।
লেখক : মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন অফিসার
এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর স্যোশাল ডেভেলপমেন্ট
এসএম