প্রতারণার অভিযোগে দুরন্ত বাজারে অবরুদ্ধ শাহেদ

চট্টগ্রামের মেধাবী প্রতারক খ্যাত নুর মোহাম্মদ শাহেদকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে পাওনাদাররা। গতকাল বুধবার (৪ জুন) সন্ধ্যা ৭টা থেকে হালিশহর থানার জি-ব্লক এলাকায় দুরন্ত বাজার নামে নিজের মালিকানাধীন সুপারশপে শাহেদকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। খবর পেয়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও ফেনীসহ বিভিন্ন এলাকার পাওনাদাররা ছুটে আসেন। পাশাপাশি হালিশহর থানা পুলিশ এবং সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করে। তবে কেউ তার এ বিষয়ে সমাধান দিতে পারেনি।
বৃহস্পতিবার (৫ জুন) বিকেলেও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিনি অবরুদ্ধ রয়েছেন। পাওনাদার কর্তৃক তাকে আটকে রাখার কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
সাব্বির হোসেন নামে এক পাওনাদার জানান, আমি তার কাছে মোট এক কোটি ১২ লাখ টাকা পাব। এক বছর আগে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে টাকাগুলো দিয়েছিলাম। আমার কাছে যাবতীয় প্রমাণ আছে। আদালতে মামলাও করেছি। দুরন্ত সাপ্লায়ার থেকে নৌবাহিনীর রেশনের পণ্য বাজার থেকে কমমূল্যে দিবেন বলে টাকা নিয়েছিলেন। দুই-তিন চালান দিয়েছিলেন। এরপর থেকে আর দেননি।
অভিযোগের বিষয়ে নুর মোহাম্মদ শাহেদ বলেন, সবাই টাকা পাবে না। কেউ কেউ পাবে। তবে তারা যে পরিমাণ বলেছে এতো টাকা পাবে না। আমি ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। তারপরও তাদের টাকা আস্তে আস্তে দিচ্ছি।
হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, শাহেদকে পাওনাদাররা আটকে রেখেছে। তারা তার সঙ্গে কথা বলে পাওনা টাকা আদায় করেছেন। আমাদের টিম এমনি খোঁজখবর নিতে গিয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, আগের সবগুলো মামলায় তিনি জামিনে রয়েছেন। আমরা পাওনাদারদের বলেছি আপনারা মামলা দেন, তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করব। তবে পাওনাদারদের বক্তব্য, মামলা দিলে তো সমাধান হচ্ছে না। গ্রেপ্তার হবে আবার বেরিয়ে যাবে। তার চেয়ে আমরা নিজেরা তার সঙ্গে কথা বলে সমাধান করি। যেহেতু পাওনাদার অনেক বেশি। সেহেতু সবার সঙ্গে কথা বলতে হয়তো সময় লাগছে।
জানা যায়, একের পর এক প্রতারণা মামলায় গত কয়েক বছরে একাধিকবার কারাগারে গিয়েছিলেন শাহেদ। সবশেষ গত ৩০ জানুয়ারি শাহেদ হালিশহর থানায় দায়ের হওয়া একটি প্রতারণা মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। কয়েকদিন কারাভোগ করে তিনি ফের জামিনে মুক্ত হন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি ‘প্রতারণাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ‘মেধাবী প্রতারক’ নুরের গল্প’ শিরোনামে ঢাকা পোস্টে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

তবে নানা আলোচনা-সমালোচনা হলেও থেমে থাকেননি শাহেদ। সম্প্রতি তিনি ফেনী লাইন নামে একটি বাস সার্ভিস চালুর ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় এসেছেন। এ লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ও কাউন্টার দেওয়ার কথা বলে নানা লোকজনের কাছ থেকে নতুন করে টাকা নিয়েছেন তিনি। বিনিয়োগকারীকে বিশ্বাস করাতে পুরাতন তিনটি বাস রঙ করে ফেনী লাইন নাম দিয়ে স্টিকার দিয়ে ফেসবুকে ছবি আপলোড দেন তিনি। পাশাপাশি কয়েকটি কাউন্টারে ফেনী লাইনের সাইনবোর্ড সাঁটানো হয়। গত ২ জুন এ বাস সার্ভিস উদ্বোধনের কথা ছিল। কিন্তু এসময়ে তিনি চালু করেননি। ফেসবুকে ফেনী লাইন চালুর ঘোষণা দেখে শাহেদের চট্টগ্রামে অবস্থান করার তথ্য পায় পাওনাদাররা। এরপর বুধবার (৪ জুন) দুরন্ত বাজারে তাকে আটকে রাখেন পাওনাদাররা।
আরও পড়ুন
নুর মোহাম্মদ শাহেদ ফেনী জেলার শর্শাদি ইউনিয়নের অবসরপ্রাপ্ত বিডিআর সদস্য মোহাম্মদ নুর নবীর ছেলে। বাবার চাকরির সুবাদে নগরের হালিশহর থানার গোলন্দাজ সড়কে আর্টিলারির পাশেই বড় হয়েছেন তিনি। এই এলাকায় নৌবাহিনীর কিছু সদস্য ভাড়া বাসায় থাকেন। এ কারণে নৌবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে শাহেদের সখ্যতা গড়ে ওঠে। নৌবাহিনীর সদস্যদের যাদের বাড়ি চট্টগ্রামের বাইরে তাদের অনেকেই প্রাপ্ত রেশন বিক্রি করে দেন। শাহেদ এসব রেশন কিনে বিক্রি করতেন। পরবর্তী সময়ে দুরন্ত বাজার নামে একটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নৌবাহিনীর লোকজনের সঙ্গে মেলামেশার কারণে তাদের বিভিন্ন বিষয়ে জানতেন তিনি। বিভিন্ন জায়গায় শাহেদ নিজেকে পরিচয় দেন নৌবাহিনীর সাব-লেফটেন্যান্ট। ২০২২ সালের ১২ আগস্ট গ্রেপ্তারের সময় খুলশী থানা পুলিশ শাহেদের কাছ থেকে নৌবাহিনীর ইউনিফর্ম, ক্যাপ, বেল্ট, ব্যাগ, জুতা, দুটি নেভির বুট জুতা, নেমপ্লেট, র্যাঙ্ক ব্যাজ ও রেড ব্যাজসহ বিভিন্ন সামগ্রী জব্দ করে।

পুলিশ জানায়, শাহেদের নামে ২০২১ সালের ২৫ জুন নগরের ইপিজেড থানায় মামলা রেকর্ড হয়। এরপর ২০২২ সালের ৩ আগস্ট খুলশী, ২০২৩ সালের ৩০ মে হালিশহর এবং সবশেষ গত ৩০ জানুয়ারি একই থানায় আরেকটি মামলা রেকর্ড হয়। এসব মামলায় শাহেদ ২০২১ সালের ২৫ জুন ইপিজেড থানা পুলিশের হাতে, ২০২২ সালের ১২ আগস্ট খুলশী থানা পুলিশের হাতে, ২০২৩ সালের ৩১ মে হালিশহর থানা এবং গত ৩০ জানুয়ারি একই থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া সচরাচর প্রতারণার অভিযোগের মামলা থানায় রেকর্ড হয় না। এ ধরনের অভিযোগে আদালতেই বেশিরভাগ মামলা হয়ে থাকে। আর আদালতে মামলা হলে সেগুলো পুলিশের ওয়েবসাইটে রেকর্ড থাকে না। শুধু থানায় মামলা হলে পুলিশের ওয়েবসাইটে রেকর্ড থাকে। শাহেদের নামে শুধু থানার মামলা পাওয়া গেছে চারটি। এর বাইরে আদালতে দায়ের হওয়া মামলাও থাকতে পারে।
তারা আরও বলছেন, থানায় কারও নামে চারটি মামলা থাকা মানে তিনি বড় ধরনের প্রতারক।
এমআর/এসআইআর