একই সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে গুলিবিদ্ধ জুলাইযোদ্ধা!

ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। এই অভিযোগে নগরীর খুলশী থানায় মামলা করেন তিনি। কিন্তু একই দিনে সাইফুদ্দীন ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন দাবি করে ঢাকার আদালতে আরও একটি মামলা করা হয়েছে। এক ব্যক্তি একই দিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুই জায়গায় গুলিবিদ্ধের অভিযোগে হওয়া মামলার এই অসঙ্গতি নিয়ে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
ওই জুলাইযোদ্ধা হলেন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার বাসিন্দা সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ। গত বছর আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে তার এক চোখ নষ্ট হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ওই ঘটনার ঠিক ১০ মাসের মাথায় চলতি মাসের ১৭ জুন চট্টগ্রামে খুলশী থানায় তৎকালীন সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার একাধিক মন্ত্রীসহ ১৬৭ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলাটি করা হয়। এ ছাড়া আসামিদের মধ্যে চট্টগ্রামের শিল্পপতি, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকেও আসামি করা হয়েছে। মামলার বাদী হলেন ভিকটিম সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ নিজেই।
তবে এই মামলার ঠিক তিন মাস আগে ভিকটিম সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ গুলিবিদ্ধের ঘটনায় ঢাকায় আরও একটি মামলা হয়েছিল। গত ২০ মার্চ হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক আইনে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের একটি আদালতে মামলাটি করেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট এম এ হাশেম রাজু। বর্তমানে মামলাটি শাহবাগ থানা পুলিশ তদন্ত করছে।
চট্টগ্রামে করা মামলার এজাহারের বর্ণনামতে, গত বছর ৪ ও ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ভিকটিম সাইফুদ্দীনের গুলিতে চোখ হারানোর কথা উল্লেখ রয়েছে। পরে আহত অবস্থায় তিনি চট্টগ্রামের হাসপাতালে ৮ আগস্ট পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছিলেন। ঢাকার মামলায়ও এজাহারে উল্লেখ রয়েছে, গত বছর ৪ আগস্ট আন্দোলন চলাকালে তিনি শাহবাগের পরীবাগ মোড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে চোখ হারান।
আরও পড়ুন
আইনজ্ঞরা এই দুটি মামলায় অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য থাকার কথা জানিয়ে মামলাটির গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। এই বিষয়ে ভিকটিম সাইফুদ্দীনকে একাধিকবার কল দিলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
ঢাকায় করা মামলার বাদী আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট এম এ হাশেম রাজু বলেন, গত বছর আগস্টে শাহবাগ থানার পরীবাগে সাইফুদ্দীন যখন আহত হয়েছিলেন, তখন সে আমাদের মানবাধিকার সংস্থা বরাবর একটি আবেদন করেছিল— এই ঘটনায় যেন একটি মামলা করা হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে। এই মামলা করার জন্য সে আমাদের কাছে এফিডেফিট দিয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে যেহেতু আমরা সবসময় অসহায় ও নির্যাতিতের পক্ষে থাকি, তাই সাইফুদ্দীনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমি নিজে বাদী হয়ে ২০ মার্চ ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করি। এই ছেলে কীভাবে গত বছর ৪ আগস্ট একই ঘটনার সময় উল্লেখ করে চট্টগ্রামে খুলশী থানায় আরও একটি মামলা করেছে— এটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। এই বিষয়ে সে ভালো বলতে পারবে।
এম এ হাশেম রাজু আরও বলেন, আমার মামলাটি আদালতের নির্দেশে শাহবাগ থানা পুলিশ যখন তদন্ত শুরু করে, পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী তারা ভিকটিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে জবানবন্দি দেওয়ার জন্য বলেছিল। কিন্তু সাইফুদ্দীন এখানে এসে এখনো জবানবন্দি দেয়নি। সে অসুস্থ বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। এতে আমার ধারণা, সে চট্টগ্রামে কোনো না কোনো লোকের খপ্পরে পড়ে চট্টগ্রামে গিয়ে এই মামলাটি করেছে। আর পরীবাগে হামলায় আহত হওয়ার পর আমি নিজে তাকে চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলাম।
তিনি দাবি করেন, গত এক মাসের বেশি সময় ধরে সাইফুদ্দীনের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই।
চট্টগ্রামের মামলার এজাহারে বাদী সাইফুদ্দীন উল্লেখ করেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরুর পর গত বছর ১ আগস্ট কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচিতে তিনি যোগ দেন। ৪ আগস্ট সরকার পতনের আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হিসেবে তিনি নিউমার্কেট মোড়ে সমবেত হন। ওইদিন সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তাদের শান্তিপূর্ণ মিছিল চললে হঠাৎ ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরা আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে অনেক ছাত্র-জনতা আহত ও নিহত হয়।
ওই হামলায় বাদীসহ বহু লোক গুলিবিদ্ধ ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জখম হয়ে নিরাপদ জায়গায় চিকিৎসা নেন। পরদিন ৫ আগস্ট বুকে ও পায়ে ব্যথা নিয়ে বাদী আবার চট্টগ্রামে বাদুরতলা এলাকায় মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন।
মিছিলটি বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, জিইসি মোড় হয়ে ওয়াসা মোড়ে পৌঁছালে একদল মারমুখী সশস্ত্র ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা হত্যার উদ্দেশ্যে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করে। এতে ছররা গুলি বাদীর মাথা, পা ও চোখে লাগার পর তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ওইদিন রাতে জ্ঞান ফেরার পর তিনি নিজেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখতে পান। পরে জানতে পারেন স্বৈরাচারের পতন হয়েছে।
৮ আগস্ট পর্যন্ত চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার কথা উল্লেখ করে বাদী এজাহারে জানান, তার ডান চোখের দৃষ্টি ফেরেনি। বাম চোখের দৃষ্টিশক্তিও কমে যাচ্ছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর বাদী চট্টগ্রামে খুলশী থানায় এই মামলা করেন।
অন্যদিকে ঢাকায় করা মামলায় বাদী উল্লেখ করেন, ভিকটিম সাইফুদ্দীন মোহাম্মদ এমদাদ একজন তালিকাভুক্ত জুলাই যোদ্ধা। গত বছর ৪ আগস্ট সকাল সাড়ে ১১টায় স্বৈরাচারী হাসিনার বিদায়ের লক্ষ্যে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন একদফা বাস্তবায়নের দাবিতে বাদীর নেতৃত্বে একটি মিছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে পরীবাগ মোড়ে হোটেল কন্টিনেন্টালের সামনে আসে।
এ সময় সকাল আনুমানিক সাড়ে ১১টায় সেখানে থাকা মামলার আসামিরা বাদী এবং ভিকটিম সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদসহ আরও অনেক ছাত্র-জনতাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ, বোমা বিস্ফোরণ করে। মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, স্প্রে, ও ছররা গুলি করে। ভিকটিম সাইফুদ্দীন এমদাদের ডান চোখে ছররা গুলি লাগে। এতে ভিকটিম আহত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়লে অজ্ঞাতনামা ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ সদস্যরা তাকে বেদম পিটুনি দেয়।
এই ঘটনাটি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছিলেন স্বয়ং মামলার বাদী। পরে ভিকটিমকে আহত অবস্থায় উদ্ধারের পর বিভিন্ন হাসপাতাল চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। অবস্থার অবনতি হলে পরে গোপনে ৫ আগস্ট ভিকটিমকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এনে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভিকটিমের কথামতো এই ঘটনায় মামলা করতে গেলে শাহবাগ থানায় মামলা না নেওয়ায় আদালতে বাদী মামলাটি করেছেন। ভিকটিম সাইফুদ্দীন মোহাম্মদ এমদাদ কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে এই মামলা করেন বলে বাদী জানান।
মামলায় তৎকালীন সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সুফী মিজান, অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন, জায়েদ খানসহ ১৯৭ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবে সম্পৃক্ত না থাকার পরও হয়রানি ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে চট্টগ্রামে করা মামলায় আসামি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলী মফিজুল হক ভুঁইয়া বলেন, এই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে আমরা তো অ্যাকশন নিচ্ছি। তথ্যের অসঙ্গতি থাকা দুই শতাধিক মামলা ইতোমধ্যে আমরা প্রত্যাহার করেছি। আরও কিছু মামলা প্রত্যাহার হতে পারে। এগুলো যাচাই-বাছাই চলছে।
আরএমএন/এমজে