শিশুদের অর্ধপোড়া বই-খাতা, প্রিয় আঙিনায় আর ফেরা হবে কি?

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় পুরো এলাকা এখন এক শোকস্তব্ধ জনপদে পরিণত হয়েছে। দুর্ঘটনার বীভৎসতার চিহ্ন হিসেবে স্কুল আঙিনায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে শিক্ষার্থীদের স্কুলব্যাগ, ছেঁড়া-ভেজা অর্ধপোড়া বই, খাতা-কলম। এই দৃশ্য যেন এক নির্মম বাস্তবতার জানান দিচ্ছে— হয়তো এই ব্যাগগুলোর অনেক মালিকই আর কোনোদিন ক্লাসে ফিরবে না।
সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরের সেই ভয়াবহ বিমান বিধ্বস্তের পর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাইমারি সেকশনের ভবনটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত।
আগুন নেভানোর পর উদ্ধারকর্মীরা যখন ভেতরে প্রবেশ করছেন, তখন তাদের চোখে পড়ছে হৃদয়বিদারক সব দৃশ্য। শিশুদের ছোট ছোট স্কুলব্যাগ, ছেঁড়া-ভেজা অর্ধপুড়া বই, পেন্সিল বক্স— সবকিছুই পড়ে আছে এলোমেলোভাবে।

জানা গেছে, দুর্ঘটনার সময় ওই বিধ্বস্ত ভবনে ক্লাস শেষে কোচিং ক্লাস চলছিল, যেখানে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। আকস্মিক এই ঘটনায় তাদের অনেকেই আগুন ও ধোঁয়ায় দগ্ধ হয়েছেন অথবা চাপা পড়েছেন ধ্বংসস্তূপের নিচে। এখন পর্যন্ত অন্তত ২০ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে, যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী।
আরও পড়ুন
এই ঘটনায় আহত এক শিক্ষক বলেন, এটা ঠিক স্কুল ছুটির সময় ছিল। শিক্ষার্থীরা গেটে অপেক্ষা করছিল। কী ঘটছে, তা বোঝার আগেই চারপাশে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই দৃষ্টিসীমা কমে আসে। আমি শুধু আগুন দেখতে পাচ্ছিলাম, তারপর ধোঁয়া...।
তিনি আরও বলেন, আমার হাত পুড়ে গিয়েছে, মুখ ও কান ঝলসে গেছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল।

পরে ওই শিক্ষক দ্রুত ওয়াশরুমে গিয়ে একটি ভেজা কাপড় নিয়ে এসে নিজের নাক ঢাকেন। তিনি বলেন, কাছে থাকা বাচ্চাদেরও আমি একই কাজ করতে বললাম। তাদের অনেকের শার্টে ততক্ষণে আগুন ধরে গিয়েছিল। আমি তাদের নিচু হয়ে থাকতে এবং মুখ ঢাকতে বললাম।
এই শিক্ষকের সঙ্গে তিনজন শিক্ষার্থী সেখান থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হয়। তাদের মধ্যে গুরুতর দগ্ধ একজনকে সিএমএইচের বার্ন ইউনিটে রেফার করা হয়।
হাসপাতালগুলোতে আহতদের ভিড় এবং স্বজনদের আহাজারি
এ বিমান দুর্ঘটনার পর রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের ভিড় এবং স্বজনদের আহাজারি এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা করেছে। অনেকেই এখনো তাদের প্রিয়জনের খোঁজ পাননি। স্কুল আঙিনায় পড়ে থাকা প্রতিটি ব্যাগ, প্রতিটি খেলার সরঞ্জাম যেন তাদের স্বজনদের মনে প্রশ্ন জাগাচ্ছে— তাদের সন্তান কি ফিরবে? এই অনিশ্চয়তা আর বেদনা নিয়েই হাজারো পরিবার এখন অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক অভিভাবক বলেন, এই প্রিয় স্কুল আঙিনাই ছিল তাদের শৈশবের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। আজ সেখানে আগুন আর ধোঁয়ার গন্ধ—অর্ধপোড়া বই, ছেঁড়া খাতা আর ছিটকে পড়ে থাকা পেনসিল বক্সগুলো যেন জিজ্ঞেস করছে, ওরা কি আর কোনোদিন ফিরবে ক্লাসে? ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।

‘স্কুল ছিল নিরাপত্তার জায়গা, স্বপ্ন দেখার মাঠ। আজ সেই স্কুলের মাঠই রঙিন খোয়াবগুলোকে ছাই করে দিয়েছে।’
আহত এক শিশুর মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, স্কুলব্যাগটা ওর পছন্দের ছিল, প্রতিদিন গর্ব করে নিয়ে যেত। আজ সেটাই পড়ে আছে ছেঁড়া আর পোড়া অবস্থায় ধ্বংসস্তূপে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি হয়ে গেল— শুধু একটা প্রশ্ন ঘুরছে, ও কি আর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ফিরবে?
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় বাসিন্দা বলছেন, বাবা-মা বই-খাতা কিনে দিয়েছিলেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে, কে জানতো সেই বইগুলোই একদিন ধ্বংসস্তূপে ছড়িয়ে থাকবে? বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে আকাশ থেকে, কিন্তু ভেঙে পড়েছে শত শত মা-বাবার হৃদয়।
২২ জুলাই রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা
বিমান বিধ্বস্ত হয়ে বহু মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় সরকার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। আগামীকাল মঙ্গলবার (২২ জুলাই) দিনটি আধা-দাপ্তরিক শোক দিবস হিসেবে পালিত হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এই মর্মান্তিক ঘটনায় সরকার গভীরভাবে শোকাভিভূত। ২২ জুলাই দেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশের বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
এছাড়া, নিহতদের মাগফিরাত এবং আহতদের সুস্থতা কামনায় মঙ্গলবার দেশের সব মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনার আয়োজন করতে বলা হয়েছে।
বিধ্বস্ত বিমান ক্রেন দিয়ে উদ্ধার
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানটি উদ্ধারে কাজ চলছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে বিমানটির ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে নিতে ক্রেন ব্যবহার করছে বিমানবাহিনী।
সোমবার দুপুরে বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকেই উদ্ধার তৎপরতা চলছিল। ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার কর্মীরা উদ্ধারকাজে অংশ নিচ্ছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিমানটি কলেজ ভবনের ছাদে আঘাত হানার পর বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে এবং মুহূর্তেই আগুন ধরে যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিট দীর্ঘ সময় অভিযান চালায়। এরপর সেনাবাহিনী, বিজিবি এবং বিমান বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধারকাজে যোগ দেন।
দুর্ঘটনায় ভবনের যে অংশে বিমানটি আঘাত হানে, সেখানে ব্যাপক ধ্বংসস্তূপের সৃষ্টি হয়। ধসেপড়া ভবনের অংশবিশেষ এবং বিমানের ভগ্নাবশেষ সরাতে দুপুরের পর ক্রেন আনা হয়। ওই সময় থেকেই সতর্কতার সঙ্গে অপসারণ কার্যক্রম শুরু করে সংশ্লিষ্ট বাহিনী।
আরও পড়ুন
উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা ফায়ার সার্ভিসের
এদিকে বিমান বিধ্বস্তের এ ঘটনায় রাত ১০টার পর উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস। তবে বিধ্বস্ত বিমানটি সরাতে এখনো কাজ করছে বিমান বাহিনী।
ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টাফ অফিসার মো. শাহজাহান শিকদার জানান, দুর্ঘটনার পর থেকেই ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযান চলে। এখন শুধু একটি ইউনিট সতর্কতা হিসেবে সেখানে অবস্থান করছে। বিমান বাহিনী বিমানটি অপসারণ করছে।
এখনো ঘটনাস্থলে বহু অভিভাবক জড়ো হচ্ছেন বলে জানান তিনি।

শনাক্ত মরদেহ দ্রুত হস্তান্তর, বাকিদের ডিএনএ পরীক্ষার পর
উত্তরায় বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের মধ্যে শনাক্ত মরদেহগুলো দ্রুত পরিবারের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাকিদের পরিচয় ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করে পরে হস্তান্তর করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে তিনি সার্বক্ষণিক নজরদারি করছেন। হাসপাতাল এলাকায় অপ্রয়োজনীয় ভিড় না করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী ও বিজিবি উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়। হেলিকপ্টারে করে হতাহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়।
প্লেনের দুই পাখায় পুড়েছে দুই ক্লাসরুম
দুর্ঘটনার পর বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ভবনে আঘাত হানে। এ সময় বিমানের নাক বা সামনের অংশ ভবনের সিঁড়িতে ঢুকে যায় এবং এর দুটি পাখার আঘাতে শিক্ষার্থীতে পরিপূর্ণ দুটি ক্লাসরুম পুড়ে ছাই হয়।

দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, বিধ্বস্ত প্লেনের অংশবিশেষ ছিটকে ভবনের সিঁড়ির সামনে চলে গেছে এবং দুটি ক্লাসরুম সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দুর্ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে এবং হতাহতদের উদ্ধার করা শুরু করে।
নিহত অন্তত ২০, আহত ১৭১
বিমান বাহিনীর এফ-৭ বিজিআই মডেলের প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানটি সোমবার দুপুর ১টার পর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে গিয়ে পড়ে এবং বিধ্বস্ত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বিমান ও স্কুল ভবনটিতে আগুন ধরে যায়। যে ভবনে এটি বিধ্বস্ত হয় সেখানে বহু স্কুলপর্যায়ের শিক্ষার্থী ছিল বলে জানা গেছে। যাদের বেশিরভাগই হতাহত হয়েছে।
দুর্ঘটনার পরপর উদ্ধার অভিযান শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। উত্তরাসহ আশপাশের ৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে এবং হতাহতদের উদ্ধার করা শুরু করে। পরে উদ্ধার অভিযানে যোগ দেয় বিজিবি ও সেনাবাহিনী। বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে হতাহতদের হাসপাতালে নেওয়া হয়।

এ ঘটনায় দগ্ধ অন্তত অর্ধশতাধিক জনকে ঢাকার জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। যারা সবাই গুরুতর দগ্ধ হয়েছে। এছাড়া উত্তরা এলাকার বিভিন্ন হাসপাতালে আরও বহু দগ্ধ ও আহত শিক্ষার্থী ভর্তি আছে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআর জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। দুপুর ১টা ৬ মিনিটে এটি উড্ডয়ন করে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি উত্তরা মাইলস্টোন কলেজের ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত হয়। বিমানটির পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর। তিনি নিহত হয়েছেন।
সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী— এ ঘটনায় অন্তত ২০ জনের প্রাণ গেছে। এ ছাড়া, আহত হয়ে আরও ১৭১ জন চিকিৎসাধীন আছেন।
প্রধান উপদেষ্টার শোক
এ ঘটনায় শোক জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শোক বার্তায় তিনি বলেন, বিমান বাহিনীর এফ-৭বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় আমি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি। দুর্ঘটনায় বিমানসেনা ও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক-কর্মচারীসহ অন্যান্যদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। জাতির জন্য এটি একটি গভীর বেদনার ক্ষণ। আমি আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি এবং সংশ্লিষ্ট হাসপাতালসহ সকল কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশ প্রদান করছি।
এমজে
