আকাশ থেকে গুলি: শিশু রিয়া গোপের মৃত্যু ও মুসার লড়াই

আজ জুলাই বিপ্লবের এক বছর পূর্ণ হলো। বিজয়ের এই বার্ষিকীতেও বাতাসে এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে বারুদের গন্ধ আর স্বজন হারানোর আর্তনাদ। এক বছর আগে দেশের রাজপথ যখন ছিল স্লোগান, বুলেট আর রক্তের রণাঙ্গন; তখন জীবন বাঁচানোর শেষ দুর্গ হয়ে উঠেছিল দেশের হাসপাতালগুলো। সেই দুর্গের সম্মুখ সারির যোদ্ধা ছিলেন চিকিৎসকেরা।
সেই ভয়াবহ দিনগুলোর জীবন্ত সাক্ষী হয়ে আজও সেই স্মৃতি বহন করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কানিজ ফাতেমা ইশরাত জাহান। সম্প্রতি ঢাকা পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তুলে ধরেছেন সেই অকল্পনীয় বাস্তবতার চিত্র।
তার বর্ণনায় উঠে এসেছে আকাশ থেকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ভয়াবহতা, ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপের মাথার খুলি ভেদ করে যাওয়া বুলেটের নির্মম গল্প এবং হাসপাতালের ওয়ার্ডে একের পর এক জমতে থাকা লাশের স্তূপের দৃশ্য, যা হাসপাতালের আনুষ্ঠানিক নিবন্ধন খাতায় তোলারও ফুরসত মেলেনি। ডা. ফাতেমার এই সাক্ষ্য শুধু ইতিহাসের একটি খণ্ডচিত্র নয়, এটি এক জাতির ট্র্যাজেডি এবং টিকে থাকার অবিস্মরণীয় আখ্যান।
তার মতে, জুলাই বিপ্লবের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই এত সংখ্যক আহতদের মিছিল এসেছিল যে হাসপাতালের নিবন্ধন তালিকায় সেগুলো লিপিবদ্ধ করাটাও ছিল কঠিন। রোগীদের নাম লিপিবদ্ধ করার চেয়ে জীবন বাঁচানোই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক বছর পর সেই অকল্পনীয় বাস্তবতার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বারবার শিউরে ওঠেন ঢামেকের নিউরোসার্জারি বিভাগের এই চিকিৎসক।
ডা. কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘জুলাইয়ের ভয়াবহ দিনগুলো পার হয়ে আজ আমি দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছি, এটা নিজের কাছেই অকল্পনীয় মনে হচ্ছে। এজন্য আমি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। তখন আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারিতে কর্মরত ছিলাম। ১৮ ও ১৯ জুলাই দেশে যে ব্যাপক পরিমাণ হতাহত হয়েছিল, সেদিন তাদের চিকিৎসা করার কিছুটা সুযোগ আমি পেয়েছিলাম।’
বুলেট-পিলেটে ঝাঁঝরা ঢাকা
১৮ জুলাইয়ের পর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করিডর যেন পরিণত হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে— জানিয়ে ডা. ফাতেমা বলেন, ওই সময় পিলেট ইনজুরি (ছোট ছোট ধাতব গোলার আঘাতে সৃষ্ট আঘাত) রোগীগুলো বেশি ভর্তি হয়েছিল। ১৯ জুলাইও ভর্তি হয়েছিল সব পিলেট ইনজুরি রোগী। তারা শুধু ছাত্র ছিল না, ছোট থেকে শুরু করে বৃদ্ধ নারী-পুরুষ, সবাই আহত হয়ে এসেছিল।
‘সেদিন আমি যখন রাউন্ড দিচ্ছিলাম, দেখি একটা মধ্যবয়সী লোক। তার পিঠ ও বুক পিলেট ইনজুরিতে ঝাঁঝরা। তার দেহে এত অসংখ্য পিলেট ছিল যে তিনি ভয়ে কান্না করছিলেন। আমি তাকে যখন সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম, তখন আমার মনের মধ্যে একধরনের ভয় হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, সামান্য একটু ক্ষত হলেই আমরা সহ্য করতে পারি না, আর এই মানুষটা কীভাবে সেই যন্ত্রণা সহ্য করছে!’
আরও পড়ুন
আকাশ থেকে গুলি : শিশু রিয়া গোপের মৃত্যু ও মুসার লড়াই
জুলাই বিপ্লবে নৃশংসতার মর্মান্তিক শিকার হওয়াদের একজন ছিল ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ। ডা. ফাতেমা সেই স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘মিডিয়ার মাধ্যমে ছোট্ট সেই রিয়া গোপের কথা হয়তো অনেকে জানেন। রিয়া আসলে ছয় বছরের একটা শিশু। সে ছিল তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। সেদিন সে প্লেনের আওয়াজ শুনে বাসার ছাদে গিয়েছিল। এরপর হেলিকপ্টার থেকে একটা বুলেট এসে সরাসরি তার মাথার একদিক দিয়ে ঢুকে আরেকদিক দিয়ে বের হয়ে যায়।’
‘ঢাকা মেডিকেল কলেজে আমরা তার অপারেশন করেছিলাম। কিন্তু তাকে আসলে বাঁচানো যায়নি। তার ইনজুরিটা খুবই মারাত্মক ছিল।’
বনশ্রীতেও আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছিল। ডা. ফাতেমা বলেন, ‘আপনারা মুসার কথা শুনেছেন, মাত্র সাত বছর বয়স। ছোট হলেও বেঁচে যাওয়া একজন যোদ্ধা সে। একটা সিঙ্গেল বুলেট মুসার মাথায় আঘাত করে চলে যায়। মুসার বাবা তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসে। কিন্তু সেই বাবা জানেনও না যে, ওই একই বুলেট তার মায়ের (মুসার দাদি) পেটেও বিদ্ধ হয়েছিল।’
তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘মুসার বাবা যেহেতু ঢাকা মেডিকেলে ব্যস্ত ছিলেন, তার অন্য স্বজনেরা মুসার দাদিকে নিকটস্থ একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। তারা বুঝতেই পারেননি যে পেটে বুলেট ঢুকেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো রকম চিকিৎসা দিয়ে তাকে বাসায় পাঠান। পরের দিন কারফিউ শুরু হয়। দাদিকে যখন অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে হাসপাতালে নিতে যান, পথেই মারা যান তিনি। তার মানে, মুসা বেঁচে গেলেও দাদি আর ফিরে আসেননি।’
নিবন্ধনহীন মরদেহ আর অবরুদ্ধ নগরী
সেই দিনগুলোতে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা হয়তো কোনোদিনই পুরোপুরি জানা যাবে না। ডা. কানিজ ফাতেমা এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘ওই সময় ঢাকা মেডিকেলে এত লাশের স্তূপ ছিল, এত রোগীর আনাগোনা ছিল যে সেগুলো আসলে লেজার বুকে (নিবন্ধন বই) তোলারও সুযোগ ছিল না। কিন্তু এর সবগুলো আমাদের কাছে প্রামাণ্য চিত্র হিসেবে আছে।’
‘সেই দিনগুলোতে অ্যাম্বুলেন্সের মতো জরুরি সেবাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল পদে পদে। যার নির্মম শিকার হয়েছিলেন মুসার দাদির মতো অগণিত মানুষ। স্বজনেরা আহতদের নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু পথের বাধা পেরিয়ে সময়মতো চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছানো ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।’
বিচারের আর্তি
ভয়াবহ এমন অভিজ্ঞতার মধ্যেও টিকে থাকার লড়াইয়ের কথা বলেছেন ডা. ফাতেমা। বলেন, ‘মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের হিকমতের (প্রজ্ঞা) সঙ্গে চলতে শিখিয়েছেন। আমরা এতদিন যাদের সঙ্গে চলেছি, হিকমার সঙ্গে চলেছি বলেই চলতে পেরেছি। আমাদের এই হিকমাগুলো ভুলে গেলে চলবে না।’
বিচারের দাবি জানিয়ে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘আমরা যখন ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনালের কাছে আমাদের জবানবন্দি দিয়েছি, প্রত্যেকটা ছবিও দিয়েছি। ওই সময় আমাদের জুনিয়র ডাক্তাররা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে ভিডিওগুলো করেছিলেন, তারা আমাকে পরে সেগুলো দিয়েছিলেন। আমরা সেগুলো ট্রাইব্যুনালে দিয়েছি। এবার দেখা যাক এর বিচার কতটা হয়! আমরা মনে করি, অবশ্যই এসব হত্যাযজ্ঞের বিচার হওয়া উচিত।’
টিআই/এমএ/এমএআর/
