পাওনা আদায়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজের ক্ষমতা চায় বিটিআরসি

বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাত নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এক যুগ আগের ২০১০ সালের পুরোনো আইন বাতিল করে সরকার নতুন একটি নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি করছে। এই নতুন আইনে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) আরও বেশি ক্ষমতা ও স্বাধীনতা পাচ্ছে। এর ফলে টেলিকম বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে, বৈষম্য দূর হবে এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোও নিয়ন্ত্রণের আওতায় আসবে।
একই সঙ্গে, নতুন আইনে অপারেটরদের জন্য সমান প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হবে। রাজস্ব সুরক্ষায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার মতো কৌশলগত ক্ষমতাও যুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন টেলিকম সেবায় স্বচ্ছ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে নাগরিকের ডিজিটাল অধিকারও সুরক্ষিত থাকবে।
আরও পড়ুন
জানা গেছে, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ইতোমধ্যে জমা পড়েছে নতুন আইনের প্রস্তাবিত খসড়া। যার নামকরণ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’। এতে (খসড়ায়) ২০১০ সালে প্রণীত ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) আইন’ অবিলম্বে বাতিল করে নতুন ও আধুনিকায়িত আইনি কাঠামো গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
কী আছে প্রস্তাবিত খসড়ায়
নতুন আইনে গবেষণা, উদ্ভাবন ও পরীক্ষামূলক সেবা চালুর ক্ষেত্রে বিটিআরসি পাচ্ছে বিশেষ ক্ষমতা। পাশাপাশি ওটিটি কনটেন্ট ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আসবে নিয়ন্ত্রণের আওতায়। এতে দেশের টেলিকম খাত আরও স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর হবে।
নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ২০১০ সালের টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) আইন একদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বাধীনতা খর্ব করেছে, অন্যদিকে জটিলতা, দীর্ঘসূত্রিতা ও পক্ষপাতিত্বের সুযোগ তৈরি করেছে— যা সুস্থ প্রতিযোগিতা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বিটিআরসি মনে করছে, ২০১০ সালের আইন বাতিল করে স্বচ্ছ, স্বাধীন ও যুগোপযোগী নতুন কাঠামো প্রবর্তন এখন জরুরি।
একই সঙ্গে নতুন খসড়া প্রণয়নে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন, সাইবার সুরক্ষা আইন, ডেটা গভর্নেন্স ও ইন্টার-অপারেবিলিটি আইন, ন্যাশনাল এআই পলিসি, টেলিযোগাযোগ লাইসেন্স, ই-কমার্স ও কুরিয়ার সার্ভিস নীতি— এসব বিষয়ক আইন-নীতি বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুন
বিষয়টি নিয়ে কাজ করা বিটিআরসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ২০১০ সালের সংশোধনী আইনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে এবং দীর্ঘসূত্রিতা ও পক্ষপাতিত্বের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যা বাজারে বৈষম্য ও বিনিয়োগের অপ্রত্যাশিত বাধা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে সরকারি ও বেসরকারি অপারেটরদের মধ্যে সমান অধিকার ও প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টিতে বাধা দিয়েছে। এ কারণে আইনের প্রাচীন ধারাগুলো বাতিল করে একটি যুগোপযোগী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুমাত্রিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
তিনি জানান, যেহেতু আধুনিক যুগে ইন্টারনেটসহ টেলিযোগাযোগ সেবা মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে, সেহেতু খসড়ায় ৯৭ ধারাটি পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের ডিজিটাল অধিকার সুরক্ষিত রাখা। পাশাপাশি, নিরাপত্তার ভারসাম্য বজায় রেখে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী আইনসম্মত নজরদারি বা ‘ল'ফুল ইন্টারসেপশন’ পরিচালনার বিধান রাখা হয়েছে। এর ফলে টেলিযোগাযোগ খাতের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার সঠিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।
এদিকে প্রস্তাবিত খসড়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতার ভারসাম্য রক্ষায় নানা প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। লাইসেন্স ইস্যু, নবায়ন ও বাতিলসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো বিটিআরসির স্বায়ত্তশাসিত ক্ষমতার আওতায় আনা হবে। তবে, সরকারের তদারকি ও সংসদীয় কমিটির নিয়ন্ত্রণ-নিরীক্ষা অব্যাহত থাকবে। এ পদক্ষেপ টেলিকম খাতকে দ্রুততর ও ফলপ্রসূ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের লক্ষ্যে অধ্যাদেশের ৩০ ধারায় বিটিআরসিকে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, গবেষণা, পরীক্ষামূলক কার্যক্রম এবং নিয়ম-নীতি প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, তরঙ্গ শেয়ারিং, লিজিং ও ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে সরকারি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওটিটি, কনটেন্ট ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মতো বিষয়গুলোকে আইনে অন্তর্ভুক্ত ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য করার সুপারিশ করা হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নতুন একটি রাজস্ব ধারা ২৬(৩) সংযোজন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) দীর্ঘদিন ধরেই কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে— প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জরিমানা আরোপ, দেওয়ানি বিষয়ে পিডিআর মামলা ও ফৌজদারি মামলা দায়ের করা এবং অপারেটরদের করা মামলার আইনি মোকাবিলা। এসব বিষয় বর্তমানেও আইনের বিভিন্ন ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
নতুন ধারা সংযোজন করতে চায় বিটিআরসি
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের রাজস্ব আদায় আরও কার্যকর করতে এবং রাজস্ব ফাঁকি রোধে খসড়ায় ২৬(৩) নম্বর ধারাটি সংযোজন করা প্রয়োজন। কারণ, এই ধারার মাধ্যমে বিটিআরসি তার পাওনা বকেয়া আদায়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার পাশাপাশি অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
‘এসব বিষয় সামনে রেখে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে।’
আরও পড়ুন
ব্যাংক হিসাব জব্দের মতো ক্ষমতা দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে
নতুন খসড়া আইন কার্যকর হলে টেলিযোগাযোগ খাত স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক হবে বলে মনে করছে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ডিজিটাল যুগে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। তবে খাতসংশ্লিষ্টদের একটি অংশ এর কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, কমিশনকে স্বাধীন করার মূল উদ্দেশ্য ছিল মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে— লাইসেন্স প্রদান, স্পেকট্রাম নিলাম বা নীতিনির্ধারণে এখনো মন্ত্রণালয়ের প্রভাব বিদ্যমান। আইন অনুযায়ী প্রতিবছর গণশুনানি আয়োজন বাধ্যতামূলক হলেও দীর্ঘদিন ধরে তা হচ্ছে না। ভোক্তাদের অভিযোগ নির্দিষ্ট সময়ে নিষ্পত্তি করার বিধানও কার্যকর হয়নি। ফলে প্রতিষ্ঠানটি জনবান্ধব নয়, বরং জবাবদিহিতাহীন হয়ে উঠছে।
তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ে বিটিআরসি অনেকটা এনবিআরের মতো কাজ করছে। তাই কমিশনকে ব্যাংক হিসাব জব্দের মতো ক্ষমতা দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। বিটিআরসিকে আগে নিজস্ব আইন মানতে হবে, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। তারপর স্বাধীনতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশ্ন আসতে পারে।
ক্ষমতা দেওয়ার পাশাপাশি স্বচ্ছ-জবাবদিহিমূলক কাঠামোর মধ্যে রাখার দাবি
বিটিআরসির ক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) সভাপতি মোহাম্মদ আমিনুল হাকিম।
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, সম্প্রতি টেলিযোগাযোগ আইন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে খসড়া করা হয়েছে। সেখানে বিটিআরসিকে নতুন কিছু ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। বিটিআরসির বিদ্যমান আইন ও ক্ষমতাগুলো নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা মিশ্র। কিছু জায়গায় কমিশনের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি।
‘কারণ, বর্তমানে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ফাইল অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হয়। যেমন— কোনো অপারেটর যদি পাঁচ বা দশ বছরের জন্য লাইসেন্স নেয়, সেটি নিয়মিত নবায়নের প্রয়োজন হয়। কিন্তু লাইসেন্স নবায়ন বা নতুন আবেদন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের ওপর নির্ভর করায় প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত হয়। এতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ে এবং কর্পোরেট হাউসগুলোর সঙ্গে চুক্তি নবায়নেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এ কারণে আমরা মনে করি, কিছু ক্ষমতা বিটিআরসিকে ফিরিয়ে দিলে পুরো প্রক্রিয়াটি দ্রুত হবে, যা শিল্পের জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
তিনি সতর্ক করে বলেন, একক কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা থাকলে অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকে যায়। তাই বিটিআরসিকে ক্ষমতা দেওয়ার পাশাপাশি একটি জবাবদিহিমূলক কাঠামোর মধ্যে রাখতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো যেন কমিশনের সভায় স্বচ্ছভাবে গৃহীত হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীরা যেন কোনো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আপিল বা নিষ্পত্তির সুযোগ পান, এমন ব্যবস্থাও রাখা জরুরি।
ডিজিটাল সেবা ও শৃঙ্খলার প্রসঙ্গে আইএসপিএবি সভাপতি বলেন, এ ক্ষেত্রে বিটিআরসির সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য। কারণ, বাস্তবে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে রাজস্ব ফাঁকি দেয় এবং নীতি ভঙ্গ করে। এতে বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই বিটিআরসিকে যদি প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও কার্যকর ভূমিকা দেওয়া যায়, তাহলে এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
‘আমরা চাই, বিটিআরসিকে ক্ষমতা দেওয়ার পাশাপাশি একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক কাঠামোর মধ্যে রাখা হোক। তাহলে একদিকে যেমন বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি হবে, অন্যদিকে ইন্ডাস্ট্রিতেও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা পাবে।’
আরও পড়ুন
রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া চলমান থাকায় মন্তব্য নয় : বিটিআরসি
তবে বিষয়টি নিয়ে এখনো রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া চলমান থাকায় বিটিআরসির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মন্ত্রণালয় পর্যায়ে খসড়াটি আলোচনায় রয়েছে এবং পরবর্তী ধাপের অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত তারা প্রকাশ্যে কিছু বলতে অপারগ।
আরএইচটি/এমজে
