মেট্রো যাত্রার স্বস্তি ম্লান করছে স্টেশনের নিচের অব্যবস্থাপনা

ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে মেট্রোরেল। দ্রুত ও আরামদায়ক যাতায়াতের জন্য এটি সাধারণ মানুষের অন্যতম ভরসায় পরিণত হয়েছে। তবে স্টেশনগুলোর আশপাশের অব্যবস্থাপনা এখন যাত্রীদের নতুন ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষ করে, মিরপুর-১০ ও ১১, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে ফুটপাত, মূল সড়কে অবৈধ দোকানপাট এবং রিকশার জটলা নিয়মিত যানজট তৈরি করছে। এতে পথচারী ও যাত্রীদের চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, স্টেশনের নিচে ও সিঁড়ির মুখে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসানো হয়েছে। চা-কফি থেকে শুরু করে ফাস্টফুড ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রির এসব দোকান ফুটপাতের বড় অংশ দখল করে রেখেছে। হাঁটার জায়গা সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় পথচারীদের মূল সড়কে নামতে হচ্ছে, ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে।
আরও পড়ুন
মেট্রোরেল থেকে নেমে গন্তব্যে পৌঁছাতে যাত্রীদের ভরসা রিকশা ও সিএনজি বা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। কিন্তু এসব যানবাহন স্টেশনগুলোর নিচে বিশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে থাকায় তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম যানজট। বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত রিকশা বেশি বিশৃঙ্খলা তৈরি করে সড়কে। অনেক সময় মূল সড়কের মাঝখানেই যাত্রী ওঠানামা করানো হয়, এতে চলাচল আরও ব্যাহত হয়।
যাত্রীরা দাবি করেছেন, মেট্রোরেল চালুর ফলে ঢাকার গণপরিবহনে স্বস্তি ফিরেছে। তবে স্টেশনগুলোর আশপাশে প্রশাসনের উদাসীনতায় অবৈধ দোকান ও রিকশার জটলা যাত্রী ভোগান্তির বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিশৃঙ্খলার পেছনে প্রধান কারণ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। নিয়মিত যানবাহনের জটলা হলেও সিটি করপোরেশন বা ট্রাফিক পুলিশের কার্যকর উদ্যোগ নেই। মাঝে মধ্যে অভিযান চালানো হলেও এতে স্থায়ী সমাধান হয়নি।

ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ কেবল লোক দেখানো অভিযান চালায়। অভিযান শেষ হলে রিকশা ও সিএনজি আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। এতে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।
এদিকে স্টেশনের আশপাশে যাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো পার্কিং বা অপেক্ষার স্থান নেই। ফলে রিকশা ও সিএনজিগুলো ফুটপাতে বা রাস্তার ওপর ভিড় জমাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা।
তারা জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষ বিকল্প পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারলে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান সম্ভব।
মিরপুর-১০-১১ ও শেওড়াপাড়ার একাধিক যাত্রী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেট্রোরেল সময় বাঁচাচ্ছে কিন্তু স্টেশনের নিচের অব্যবস্থাপনা সেই স্বস্তি ম্লান করে দিচ্ছে। বিশেষ করে সিঁড়ি দিয়ে নামা বা ওঠার সময় রিকশা ও দোকানপাটের জটলা যাত্রীদের জন্য বেশ ভোগান্তির কারণ হচ্ছে। নগরবাসী নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ চলাচলে দ্রুত এর সমাধানের দাবি জানিয়েছেন তারা।

মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশনে আশরাফ নামে এক যাত্রী বলেন, ‘মেট্রোরেল বাংলাদেশের গণপরিবহনে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তন টেকসই করতে হলে স্টেশনগুলোর আশপাশের অব্যবস্থাপনা দূর করা জরুরি। সমস্যাগুলো উপেক্ষা করা হলে মেট্রোরেলের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। তাই কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।’
মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশনে দায়িত্ব পালনরত এক পুলিশ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা চাইলেই উচ্ছেদ করতে পারি না। ওপর থেকে নির্দেশনা আসতে হয়। যতটুকু পারি রিকশা-সিএনজি সরিয়ে দেই কিন্তু ফুটপাতের দোকান সরানো আমাদের এখতিয়ার নয়। এটা সিটি করপোরেশন ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।’
এ বিষয়ে জানতে মেট্রোরেল এলাকার দায়িত্বে থাকা মিরপুর জোনের ডিসি মোহাম্মদ মাকছুদের রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
মেট্রোরেলের নিচে রিকশা ও অবৈধ দোকানপাটের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (উপসচিব) ও অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেব না। গত দুদিন ছুটিতে ছিলাম, আজ অফিস করছি। এ বিষয়ে আমি কিছু বলবো না।’

মেট্রোরেলের নিচে অব্যবস্থাপনা নিয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) পরিচালক (প্রশাসন) এ কে এম খায়রুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের বর্তমানে চারজন ম্যাজিস্ট্রেট আছেন। ইতোমধ্যেই বিজয় সরণি, শাহবাগ, বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরা উত্তর ও উত্তরা সেন্টার স্টেশনে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু উচ্ছেদ করে আসতে না আসতেই আবার লোকজন বসে যায়।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মেট্রোরেল শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটিকে কেন্দ্র করে এক ধরনের টাউনশিপ গড়ে উঠেছে। মেট্রোরেলকে শুধুমাত্র ব্রডব্যান্ড কানেক্ট হিসেবে না দেখে ফিডার কানেকটিভিটি করার প্রয়োজন ছিল কিন্তু পরিকল্পনায় ত্রুটি থাকায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। স্টেশন থেকে নামার পর ফুটপাতের কানেকটিভিটি দেখতে পাচ্ছি। নিরবিচ্ছিন্ন ফুটপাত তৈরি করা হয়নি, ফরমাল কানেকটিভিটি করা হয়নি। এর ফলে উচ্ছৃঙ্খল যানবাহনগুলো স্টেশনের ভেতর পর্যন্ত চলে আসছে।’
তিনি বলেন, ‘উন্নয়নের ধাপগুলো হওয়া উচিত ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক; প্রথমে ফুটপাত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, গণপরিবহনকে শক্তিশালী করা, তারপর তার ওপর চাপানো উচিত ছিল মেট্রোরেল। তাহলে কার্যকর ইন্টার কানেকটিভিটি তৈরি করা যেত। পরিকল্পনায় এই ঘাটতির কারণেই আজ এই অব্যবস্থাপনা।’
এসআর/এমএসএ
