লিবিয়ার মরুভূমিতে ফেলে রাখা মানব পাচার চক্রের সদস্য নজির গ্রেপ্তার

গ্রিসে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়ায় পাচার করে মুক্তিপণ আদায় করা একটি সক্রিয় চক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
গ্রেপ্তার ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ নজির হোসেন (৫৫)।
বুধবার (১০ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা থেকে নজিরকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
সিআইডি জানায়, নজিরের বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে যা বর্তমানে সিআইডিতে তদন্তাধীন। সর্বশেষ গত ৪ ডিসেম্বর এক ভুক্তভোগী নজির ও চক্রের অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান এসব তথ্য জানান।
হাজীগঞ্জ থানায় মানব পাচারের অভিযোগে হওয়া মামলার এজাহারের তথ্য উল্লেখ করে জসীম উদ্দিন খান বলেন, চক্রটির অন্যতম সদস্য গ্রিস প্রবাসী মো. শরীফ উদ্দিন (৩৩) বিগত ২০২৪ সালে দেশে এসে মামলার বাদী ও অন্য এক ভুক্তভোগী যুবককে গ্রিসে লোভনীয় বেতনের চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এ জন্য জনপ্রতি ১৫ লাখ টাকা চুক্তি হলে প্রাথমিকভাবে বাদীসহ আরেক ভুক্তভোগী পাসপোর্ট এবং ২ লাখ টাকা করে বিবাদী মো. শরীফ উদ্দীনের কাছে দেন। পরে ওই বছরের জুলাই মাসে শরীফ উদ্দিন বাদী ও আরেক ভুক্তভোগীকে বাংলাদেশ থেকে বিমানে করে দুবাই, পরে সেখান থেকে মিসর হয়ে লিবিয়ায় পাঠান।
তিনি বলেন, লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর চক্রের মনোনীত ব্যক্তি তাদের গ্রহণ করে এবং পরে একদল মাফিয়ার হাতে তুলে দেয়। সেখানে তাদের কাছ থেকে ডলার ও ইউরো ছিনিয়ে নেওয়া হয় এবং আটক রেখে শারীরিক নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি মুক্তিপণ দাবি করা হয়। দেশে বসে চক্রের হয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী গ্রেপ্তার নজির ও অন্যান্য সহযোগীরা দুই ভুক্তভোগী পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করেন। তাঁরা বিভিন্ন সময় ও তারিখে এক ভুক্তভোগী যুবকের পরিবারের কাছ থেকে মোট ২১ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং অন্য যুবকের পরিবারের কাছ থেকে মোট ১৬ লাখ টাকা আদায় করেছেন।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিপণের টাকা নেওয়ার পরও ভুক্তভোগীদের মুক্তি না দিয়ে লিবিয়ার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ৪৫ দিন জেল হাজতে কাটানোর পর ২৯ আগস্ট বাদী ও অন্য যুবকটি আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর সহায়তায় বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে আসামিদের কাছে টাকা চাইলে তাঁরা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন।
নজিরের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য উল্লেখ করে জসীম উদ্দিন খান বলেন, নজির দীর্ঘদিন যাবৎ ভুক্তভোগীদের প্রলুব্ধ করে ইউরোপ নেওয়ার কথা বলে লিবিয়া পাঠিয়ে আসছে। উচ্চ বেতনের চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মোট ১৯ জনের কাছ থেকে প্রতারণামূলকভাবে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা আদায় করার অভিযোগ রয়েছে চক্রটির বিরুদ্ধে। যার মধ্যে ৯ জন ভুক্তভোগী আইওএমের সহায়তায় দেশে ফেরত আসতে পেরেছেন। বাকিরা এখনো লিবিয়ার বিভিন্ন মাফিয়ার কাছে আটক আছেন।
তিনি বলেন, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ডিএমপির ডেমরা মডেল থানায় রুজু হওয়া অপর এক মামলায়ও গ্রেপ্তার মোহাম্মদ নজির হোসেনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে সিআইডি। ওই মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, চক্রটির অন্যতম সদস্য এজাহারনামীয় ১ নম্বর অভিযুক্ত মো. বাহাদুর ফারাজীর (৫৫) সঙ্গে ভুক্তভোগী বাদীর মোবাইলে পরিচয় হয়। বাদীকে গ্রিসে লোভনীয় বেতনের চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব দিলে বাদী রাজি হয়ে ফারাজীকে পাসপোর্ট ও নগদ ৮ লাখ টাকা দেন।
মামলার তদন্তকালে জানা যায়, চলতি বছরের জুলাই মাসে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নজির ভুক্তভোগী বাদীকে পাসপোর্ট, ভিসা ও টিকেট সরবরাহ করেন। পরে বাদী দুবাই, মিসর হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছালে চক্রের অন্য এক সদস্য তাঁকে গ্রহণ করে এবং তাকে লিবিয়ার বেনগাজির একটি বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা দাবি করে। আগের ঘটনার মতো নজির ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে মোট ১১ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে। মুক্তিপণ পেয়ে লিবিয়ায় অবস্থানরত চক্রের সহযোগীরা ভুক্তভোগীকে মরুভূমিতে ছেড়ে দেয়। পরে স্থানীয় লোকজন তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। লিবিয়ায় মোট ১৯ দিন কারাবন্দী থাকার পর এই ভুক্তভোগী বাদী আইওএমের সহায়তায় ২৫ আগস্ট দেশে ফিরতে সক্ষম হন।
এমএসি/বিআরইউ