মগবাজারে যাওয়াই কি ছিল তাদের অপরাধ!

দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকার কর্মীদের আনা-নেওয়ার কাজে নিয়োজিত গাড়ির মালিক জাফর আহমেদ (৬১)। রোববার (২৭ জুন) ব্যক্তিগত কাজে মগবাজার চৌরাস্তা থেকে হেঁটে ওয়্যারলেস গেটের দিকে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ বিস্ফোরণে আগুনের ফুলকি এসে পড়ে তার ওপর।
ঘটনাস্থলেই দগ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান তিনি। স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সহায়তায় তাকে নেওয়া হয় শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।

অন্যদিকে, প্রাইভেটকার চালক সৈকত স্বপন (৩৫) মগবাজারের চেয়ারম্যান গলিতে থাকেন। সন্ধ্যায় ওই সড়কে যাওয়ার পথে তিনিও আগুনে দগ্ধ হন। তাকেও মুমূর্ষু অবস্থায় নেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে।
হাসপাতাল থেকে সৈকত স্বপনের ছেলে বিশাল আহাজারি করে বলেন, আমার বাবা প্রাইভেটকার চালক। তিনি কখনও গাড়ি নিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েননি। অথচ আজ হেঁটে যাওয়ার পথে আগুনে দগ্ধ হলেন। তবে কি মগবাজারের চৌরাস্তা সড়ক দিয়ে হেঁটে যাওয়াই তার অপরাধ ছিল!
বিশাল আরও বলেন, বাবা সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়েছিলেন নাস্তা কেনার জন্য। বাবা আর ফিরলেন না। তার স্থান আজ বার্ন ইনস্টিটিউটে।
আলোকিত বাংলাদেশ’র ফিন্যান্স বিভাগের প্রধান জামিল হোসেন দগ্ধ জাফরকে দেখতে গিয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি জাফর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি কথা বলতে পারছেন, কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে।
উল্লেখ্য, মগবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় সাতজন নিহত হয়েছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মুহা. শফিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কথা বলে আমরা যেটা জেনেছি, এখানে যে সরমা হাউজ ছিল মূলত সেখান থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সেখানে খুব সম্ভবত গ্যাস জমেছিল এবং এ গ্যাস বিস্ফোরণের কারণে আশপাশের সাতটা বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুইটা বাস বিধ্বস্তের মতো হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা সাতজন মারা গেছে বলে খবর পেয়েছি।’
মারা গেছেন যারা
মগবাজারের কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান দুজন। তারা হলেন- সুবহানা নামের নয় মাসের এক শিশু এবং অজ্ঞাতনামা (৪০) এক ব্যক্তি। হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শাহ পরাণ বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান জান্নাত (২২) নামের এক নারী। ঘটনাস্থলেই তার শিশুসন্তান তায়েবা (১) মারা যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া এ খবর নিশ্চিত করেন। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়ার পর দুজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। সেখানে রাত সাড়ে ১১টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান স্বপন (৩৫) নামের একজন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শঙ্কর পাল।
দগ্ধ তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক : সামন্ত লাল
মগবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় দুজনকে মৃত অবস্থায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন। রোববার (২৭ জুন) রাত ১০টায় ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় মোট ১৭ জনকে আমাদের এখানে আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজনকে আমরা মৃত অবস্থায় পাই। তিনজন ছিলেন দগ্ধ। এর মধ্যে দুজনকে আইসিইউতে, একজনকে এসডিইউতে রাখা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দগ্ধ তিনজনের অবস্থা খুবই খারাপ। নাইনটি পারসেন্ট বার্ন। তাদের সম্পর্কে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। বাকি আহতরা যারা আছেন, তাদের কারও পা কাটা গেছে, কারও পা ভেঙে গেছে।
কী কারণে তারা দগ্ধ হয়েছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা এখন বলা যাচ্ছে না।
ঢামেকের জরুরি বিভাগে যারা চিকিৎসাধী
রনি (২৭), জিয়াম (২৫), মাহবুব (৩০), অজ্ঞাত (২৫), লাভলু (৬০), সাজিদ (১৮), মিজান (৪২), ইকবাল (৫০), অজ্ঞাত (২৮), ইলিয়াস (২৬), রফিকুল (৩৫), সোহেল (২৬), জহির খান (২৬), সাজ্জাদ (৩৫), আবু খায়ের (৩৫), সুভাষ (৫৮), কামাল (৪২), অজ্ঞাত (৩২), আসাদ (২৭), মোক্তার (৩৫), রতন (৩০), অজ্ঞাত (৫৫), অজ্ঞাত (৫০), অজ্ঞাত (২৫), শাহজাহান (৪৫), নয়ন (২২), মুসা (৫০), ফজল (২৫), মিজান (২৫), রাকিবুল (৩০), হৃদয় (৩০), অজ্ঞাত (৩০), ইকবাল (৩০), মামুন (৪০), মাসুদ (৫০), শাহিন (৬০), কামাল (৪২), আইয়ুব (২৫), তপন (৩৫), অজ্ঞাত (৫০), কালু (৩৫), শাহ আলম (৫০) ও নাহিদ (২৬)।
রোববার (২৭ জুন) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মগবাজার ওয়্যারলেস গেট এলাকা হঠাৎ বিস্ফোরণের কেঁপে ওঠে বলে স্থানীয়রা জানান। অনেকের কাছে তা ভূমিকম্পের মতো মনে হয়েছিল। পরে দেখা যায়, মগবাজার-মৌচাক সড়কের পাশে ৭৯ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডে ‘রাখি নীড়’ নামের পুরানো একটি তিনতলা ভবন আংশিক ধসে পড়েছে। ওই ভবনের দোতলায় ইলেকট্রনিক পণ্য সিঙ্গারের বিক্রয় কেন্দ্র ছিল। নিচতলায় খাবারের দোকান সরমা হাউজ ও বেঙ্গল মিটের দোকান ছিল। বিস্ফোরণে প্রতিষ্ঠান দুটি যেন মিশে গেছে, বিভিন্ন পিলারও ধসে পড়েছে।
বিধ্বস্ত ভবনের উল্টো পাশের সড়কে আড়ংয়ের শোরুম। বিস্ফোরণে আড়ং ও তার পাশের প্রায় ডজনখানেক ভবনের জানালা-দরজার কাচ ভেঙে রাস্তার ওপর পড়ে থাকতে দেখা যায়। এছাড়া সড়কের ওপর লাব্বাইক ও আল মক্কা পরিবহনের দুটি বাস এবং উড়াল সড়কের ওপর আজেমরী পরিবহনের একটি বাস প্রায় বিধ্বস্ত হয় পাওয়া যায়। দুটি বাসের সবগুলো কাচ ভাঙা অবস্থায় ছিল। বাসের ভেতরে ও রাস্তায় ছিল ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।
জেইউ/ওএফ