মরদেহের অপেক্ষায় থাকেন তারা

হাসপাতালে লোকজন আসেন চিকিৎসা করতে। রোগ সেরে ঘরে ফিরবেন এমন প্রত্যাশা সবারই। এর মধ্যে কারও কারও আর সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরা হয় না। স্বজনদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে তারা পাড়ি দেন অনন্তপানে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল এলাকার কিছু মানুষ চান, হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসুক মরদেহ। মরদেহ নিয়ে দরদাম করেন এসব লোকজন। তারাই মূলত মরদেহবাহী মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্সের মালিক-চালক।
সরেজমিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সময় এভাবেই ক্ষোভ ঝাড়লেন রোগীর এক স্বজন।
কয়েকদিন আগে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বাসিন্দা আবদুল হামিদকে (৬০) নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন ভাই ইস্রাফিল হক। সোমবার (৫ জুলাই) সকালে করোনা আইসোলেশন ইউনিটে মারা যান তিনি। ব্যয়বহুল চিকিৎসায় যখন বিপর্যন্ত পরিবার, তখন কাঁধে চেপে বসে মরদেহ। বাড়ি পৌঁছাতে গুনতে হয় তাদের ৭ হাজার টাকা।
ইস্রাফিল হক জানিয়েছেন, রাজশাহী থেকে তাদের বাড়ির দূরত্ব প্রায় ১১০ কিলোমিটার। মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সকে ভাড়া দিতে হচ্ছে ৭ হাজার টাকা। এর কমে তারা যাবেন না। এখন উপায় নেই।
তিনি বলেন, করোনায় মারা যাওয়ায় অন্যকেউ মরদেহ নিতে চান না। আবার হাসপাতাল এলাকায় মরদেহবাহী মাইক্রোবাস চালকদের সিন্ডিকেট অন্য মাইক্রোবাসে নিতেও বাধা দিচ্ছিল। তাই বাধ্য হয়ে রাজি হতে হয়েছে। এর আগে রোববার (৪ জুলাই) সকাল ৯টা থেকে সোমবার (৫ জুলাই) সকাল ৯টা পর্যন্ত রামেক হাসপতালে মারা যান ১৮ জন।
এদের মধ্যে রাজশাহীর বাসিন্দা ৮ জন। এছাড়া নওগাঁর ৪ জন, নাটোরের তিনজন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা ও কুষ্টিয়ার একজন মরে মারা গেছেন। সকাল ১০টার পর হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছে এসব মরদেহ।
এর আগে গত ১ জুলাই ২২ জন, ২ জুলাই ১৭ জন, ৩ জুলাই ১৩ এবং ৪ জুলাই ১২ জন প্রাণ হারিয়েছেন রামেক হাসপাতালে। গত বছরের এপ্রিল থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ১৪ মাসে রামেক হাসপাতাল করোনা আইসোলেশন ইউনিটে প্রাণ হারিয়েছেন এক হাজার ৭৮ জন। এদের প্রায় সবারই মরদেহ বহন করেছে হাসপাতাল কেন্দ্রীক এ সিন্ডিকেট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালে কোনো রোগী মারা গেলেই খবর চলে যায় এ সিন্ডিকেটের কাছে। তারাই নিদেজের অ্যাম্বুলেন্সে মরদেহ বহনে বাধ্য করেন স্বজনদের।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই রামেক হাসপাতাল এলাকায় রোগী ও মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স-মাইক্রোবাস চালকেদের চক্র সক্রিয়।
রোগী ও স্বজনদের জিম্মি করে তারা তিন থেকে চারগুন বাড়তি ভাড়া আদায় করে আসছেন। বার বার উদ্যোগ নিয়েও এ চক্রকে ভাঙতে পারেনি প্রশাসন। তবে নৈরাজ্য দেমনে গত বছরের মার্চে মাইক্রোবাস মালিক ও চালকদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রতি মাইল ৩০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে রামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওই সময় বৈধ ৬৬টি মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতাল চত্ত্বরে প্রবেশের অনুমতি পায়। তারপরও নিয়ম ভেঙে হাসপাতালের ভেতরেই অবস্থান করছে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সগুলো। আর মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স কিংবা মাইক্রোবাস অবস্থান নিয়েছে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রধান ফটকের বাইরের সড়কে।
রোগী কিংবা মরদেহ হাসপাতাল থেকে বের হলেই জিম্মি করছেন এ চক্রের সদস্যরা। এ নিয়ে প্রায়ই ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা। তবে চালকরা দাবি করছেন, আগের তুলনায় এখন ভাড়া কম।
এ বিষয়ে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানিয়েছেন, বিষয়টি তারা পুলিশকে জানিয়েছেন। যারা এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনত ব্যবস্থা নেবে।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/এমএএস