সরকারের উল্টো নীতিতে হেঁটে চলে ঢাকা

>> ১০ বছরে গাড়ির চাপ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি
>> মোট নিবন্ধিত গাড়ির ৪৯ শতাংশ মোটরসাইকেল
>> মানুষের পায়ে চলার গতিতে চলছে ঢাকার বাসগুলো
>> ১৬ বছর ধরে ঝুলছে কোম্পানিভিত্তিক বাস চলাচলের সুপারিশ
>> ঘণ্টায় বাস চলে ৫ কি.মি., ১৪ বছর আগে চলত ২১ কি.মি.
>> বছরে লাখ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে যানজটে
গত ১৬ বছরেও গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় রাজধানী ঢাকা এখন মুমূর্ষু। সকাল থেকেই স্থির হয়ে থাকে ঘনবসতির এ মহানগরী। ছোটগাড়ির চাপে ভেঙে পড়ছে ৪০০ বছরের পুরনো এ শহর। বিশ্বের দুই শতাধিক নগরীর মধ্যে যানজটে শীর্ষে স্থান করে চিহ্নিত হয়েছে ঢাকা মহানগর।
ঢাকায় মানুষের পায়ে চলার গতিতে চলে বাস। দেখে মনে হয়, হেঁটে চলছে রাজধানী শহরটি। বছরে ঢাকার যানজটে আর্থিক ক্ষতি লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ- বিআরটিএ’র সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত বিভিন্ন শ্রেণির গাড়ি ১৬ লাখ ৩০ হাজার ৩৬টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেলই সাত লাখ ৯৫ হাজার ১৯৬টি। মোট নিবন্ধিত গাড়ির প্রায় ৪৯ শতাংশ। ২০১১ সালে নিবন্ধিত মোটরযান ছিল সাত লাখ দুই হাজার ৯৪৭টি। গত ১০ বছরে গাড়ির চাপ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।
পরিবহনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা ও সুপারিশের উল্টোপথে চলছে ঢাকা। এ মহানগরী এখন মৃতপ্রায়। বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের মতো করে প্রকল্প নিচ্ছে। তাতে সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। ফলে যানজট বাড়ছে
অধ্যাপক ড. সামছুল আলম, পরিবহন বিশেষজ্ঞ
মোটরসাইকেলের নিবন্ধনহার ৪৯ শতাংশ হলেও বাসের নিবন্ধনহার দশমিক ৩৬ শতাংশ। ছোট গাড়ি, ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়ছেই। অথচ সরকার ছোট গাড়ির নিবন্ধন নিয়ন্ত্রণের পক্ষে নীতিগ্রহণ করেছে। বিশেষজ্ঞদের বার বার সুপারিশের পর সরকার সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮ তে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছে। আইনে যুক্ত করা হলেও ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ নেই।
বিআরটিএ’র পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকায় নিবন্ধিত ব্যক্তিগত গাড়ি বা প্রাইভেট কার তিন লাখ ৪৬৪টি। পরিবেশ রক্ষাকর্মী আবু নাসের খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাসের চেয়ে কম যাত্রী পরিবহনের বাহন প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়েও ফল হচ্ছে না।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলনে, ‘পরিবহনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা ও সুপারিশের উল্টোপথে চলছে ঢাকা। এ মহানগরী এখন মৃতপ্রায়। বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের মতো করে প্রকল্প নিচ্ছে। তাতে সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। ফলে যানজট বাড়ছে।
জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন নগরীর সঙ্গে তুলনা করে যানজট পরিস্থিতি নিয়ে বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে ঢাকা যানজটের শীর্ষ নগরী বলে চিহ্নিত হয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স- ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে যানজটের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার স্থান বিশ্বে প্রথম বলে চিহ্নিত করে। ২১২টি শহরের মধ্যে যানজটের জন্য ঢাকার স্কোর ছিল ২৯৭.৭৬, কলকাতার ২৮৩.৬৮ পয়েন্ট। ২০১৮ ও ২০১৭ সালে এক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়, ২০১৬ সালে ছিল তৃতীয়, ২০১৫ সালে অবস্থান ছিল অষ্টম।
বাসভিত্তিক গণপরিবহন ব্যবস্থায় জোর না দিয়ে উড়াল সেতু করলে যানজট কমবে না। আমি ২০০৯ সালে গবেষণা করে দেখিয়েছিলাম, রাজধানী ঢাকার ৭৩টি স্থানে ইউলুপসহ ওভারপাস বা আন্ডারপাস করলে যানজট অর্ধেক কমে যাবে। তাতে ব্যয় হতো প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। গাড়ি চলাচল করতো বিনা বাধায় ও নিরবিচ্ছিন্নভাবে। আমার এ প্রস্তাব কেউ আমলে নেয়নি
সন্তোষ কুমার রায়, সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলী
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, যানজট তীব্র হচ্ছে ছোটগাড়ি নিয়ন্ত্রণ না করায়, সেই সঙ্গে দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থা সুপারিশকৃত সময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ায়।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যানুসারে, ঢাকায় দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে ছয়টি পথে মেট্রোরেল, একটি পথে বাস র্যাপিড ট্রানজিট- বিআরটি স্থাপনের কাজ এখনও শেষ হয়নি। বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে জানান, ঢাকার চারদিকে রেলপথ স্থাপন করা হবে। সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে। সওজ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার চারপাশে সড়ক নির্মাণ প্রকল্প প্রক্রিয়ায় আছে। এভাবে শুধু প্রক্রিয়ার কারণে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ঘুরছে। অবস্থা এমন যে, ২০০৪ সালে প্রণীত ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা- এসটিপিতে সুপারিশ করা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়ায় তা আবার সংশোধন করে ২০ বছর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০১৫ সালে। এখন সংশোধিত এ পরিকল্পনা করা হয়েছে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত। সময় বাড়ানোর পরও সুপারিশ অনুসারে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রবণতা আগের মতোই।
সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ঢাকার যানজট কমাতে ৪৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে ১১ বছরে। সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার তথ্যানুসারে, রাজধানীতে যানজটে ক্ষতি হচ্ছে বছরে ১১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। দেশের বিভিন্ন শহরে বসবাসকারী ৩২ শতাংশের বেশি মানুষের বাস ঢাকায়। আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকার কথা থাকলেও ঢাকায় আছে ৭ শতাংশ
ওই এসটিপিতে ঢাকায় কোম্পানিভিত্তিক বাস চলাচল ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের চাপে এ সুপারিশ বাস্তবায়নে কমিটি করা হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তখনকার মেয়র সাঈদ খোকন এ নিয়ে সভাও করেন, বার বার আশ্বাসও দেন। কিন্তু প্রকল্প গ্রহণের পথে বাধা হয়ে আছে নানা প্রক্রিয়া। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে পরামর্শক হিসেবে যুক্ত ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করছি। প্রাথমিক প্রতিবেদন কমিটির সদস্যরা খতিয়ে দেখছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১০ নভেম্বর এ সংক্রান্ত ১৩তম সভা হয়েছে। সভায় ঢাকায় বাস চলাচলের পথসংখ্যা ২৯৫ থেকে কমিয়ে ৪২টি করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। অতীতের মতো এ সভায়ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, প্রকল্পের প্রাথমিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। কোম্পানিভিত্তিক বাস চলাচলের সুপারিশ ১৬ বছর ধরে ঝুলছে। এভাবে ছোট ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের আলোকে প্রকল্প না নিয়ে উড়াল সড়ক ও সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, কমিশনের লোভে নীতিনির্ধারকদের ভুল বুঝিয়ে একের পর এক প্রাইভেট কারবান্ধব অবকাঠামো উড়াল সেতু ও সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। তার চেয়ে বাস চলাচলের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল।
কমিশনের লোভে নীতিনির্ধারকদের ভুল বুঝিয়ে একের পর এক প্রাইভেট কারবান্ধব অবকাঠামো উড়াল সেতু ও সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। তার চেয়ে বাস চলাচলের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল
অধ্যাপক ড. সামছুল আলম, পরিবহন বিশেষজ্ঞ
সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলী সন্তোষ কুমার রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাসভিত্তিক গণপরিবহন ব্যবস্থায় জোর না দিয়ে উড়াল সেতু করলে যানজট কমবে না। আমি ২০০৯ সালে গবেষণা করে দেখিয়েছিলাম, রাজধানী ঢাকার ৭৩টি স্থানে ইউলুপসহ ওভারপাস বা আন্ডারপাস করলে যানজট অর্ধেক কমে যাবে। তাতে ব্যয় হতো প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। গাড়ি চলাচল করতো বিনা বাধায় ও নিরবিচ্ছিন্নভাবে। আমার এ প্রস্তাব কেউ আমলে নেয়নি। ঢাকার ভেতর থেকে বাস টার্মিনাল সরানোর প্রস্তাবও করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বা সড়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ প্রস্তাবের বিষয়ে আগ্রহ দেখাননি।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ঢাকার যানজট কমাতে ৪৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে ১১ বছরে। সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার তথ্যানুসারে, রাজধানীতে যানজটে ক্ষতি হচ্ছে বছরে ১১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। দেশের বিভিন্ন শহরে বসবাসকারী ৩২ শতাংশের বেশি মানুষের বাস ঢাকায়। আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকার কথা থাকলেও ঢাকায় আছে ৭ শতাংশ।
২০১৮ সালে বুয়েটের ‘দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট’র গবেষণায় উঠে এসেছে, রাজধানীর রাস্তায় যানজটে একটি বাস ঘণ্টায় চলাচল করতে পারে পাঁচ কিলোমিটার। ১৪ বছর আগে গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এ কারণে দিনে নষ্ট হচ্ছে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা।
২০১২ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) তথ্য দিয়েছিল, রাজধানী ঢাকার যানজটে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৩১ হাজার কোটি টাকা। ২০১৫ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড (বিওআই) জানায়, এ ক্ষতির পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা। অবস্থার উন্নয়ন না হওয়ায় এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি বলে জানিয়েছেন গবেষক সন্তোষ কুমার রায়।
পিএসডি/এমএআর