৪২ হাজার রোহিঙ্গার ২৮ হাজার জনকে ‘স্বীকার’ মিয়ানমারের

>> মিয়ানমারকে দেয়া হলো রোহিঙ্গাদের নতুন তালিকা
>> ১৪ হাজার রোহিঙ্গার নাম নেই মিয়ানমারের ডাটাবেজে
>> আশার আলো থাকলেও পূর্বের অভিজ্ঞতা ভালো নয়
>> ভাসানচরে নেয়া হলো ৩৪৪৬ রোহিঙ্গাকে
বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে নতুন করে আরও দুই লাখ ৩০ হাজার জনের তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ।
মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ঢাকা পোস্ট-কে জানান, সম্প্রতি মিয়ানমারকে এই তালিকা হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। দুই লাখ ৩০ হাজারের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা যাচাই-বাছাই করে সেখান থেকে ২৮ হাজার জনকে তাদের বাসিন্দা বলে স্বীকার করেছে মিয়ানমার। এদের মধ্যে ১৪ হাজার রোহিঙ্গার নাম দেশটির ডাটাবেজেই নেই বলে ঢাকাকে জানিয়েছে নেইপিদো।
যাচাই-বাছাই করাদের মধ্যে ৩৫০ জনকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তালিকা গ্রহণ করা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের ভাষ্য জানতে চাইলে জ্যৈষ্ঠ এ কর্মকর্তা বলেন, ‘মিয়ানমারতো এর আগেও তালিকা নিয়েছে, কিন্তু একজনকেও ফিরিয়ে নেয়নি।’
এ বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের পক্ষ থেকে নতুন করে রোহিঙ্গাদের তালিকা গ্রহণ করার বিষয়টি ইতিবাচক। তবে পূর্ব অভিজ্ঞতায় বিষয়টি বাংলাদেশকে স্বস্তি দিচ্ছে না বলেও ভাষ্য বিশ্লেষকদের।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘মিয়ানমার তালিকা নিচ্ছে এটা ভালো কথা। তবে এটাতে আমরা খুশি হতে পারছি না। কারণ তালিকা নেওয়ার বিষয়টি এ নিয়ে কয়েকবারইতো হলো। কিন্তু কোনো ফলাফল আসেনি। আমাদের চেষ্টা করতে হবে যে করেই হোক প্রত্যাবাসন শুরু করা।’
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া শুরু করেন। বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে, প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত হিসেবে রয়েছেন। এরপর থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে প্রথমবারের মতো ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে আট হাজার ৩২ জনের তালিকা দেওয়া হয়। দ্বিতীয়বার ২২ হাজার ৪৩২ জনের তালিকা দেওয়া হয় একই বছরের অক্টোবরে। এরপর ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট চার দফায় মিয়ানমারকে এক লাখ ছয় হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দেয় বাংলাদেশ।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখের মতো রোহিঙ্গা।
আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেটি আজও শুরু হয়নি।
গত বছর দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের সাড়ে তিন বছর পার হলেও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত না পাঠাতে পারার আক্ষেপ প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সবধরনের সহযোগিতা থাকলেও মিয়ানমারের আন্তরিকতার কারণে প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে না বলে বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
সবশেষ গত রোববার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে দুটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আলোচনা চালিয়ে গেলেও মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে না। তাদের আন্তরিকতার অভাবের কারণের একটি রোহিঙ্গাও ফেরত যায়নি।’
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের তালিকা নিলেও তাদেরকে ফিরিয়ে নিতে দেশটির পক্ষ থেকে শিগগিরই সাড়া দেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কারণ গত বছরের নভেম্বরে দেশটিতে হওয়া নির্বাচনের ফলাফল এলেও চলতি বছরের এপ্রিলে নতুন সরকার গঠন করবে সু চির দল। সরকার গঠন করার পরপরই দেশটি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তরিকতা দেখাবে কি না সেদিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে বাংলাদেশকে।
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করেছে সরকার। সেখানে দুই দফায় তিন হাজার ৪৪৬ জন রোহিঙ্গাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গত ৪ ডিসেম্বর এক হাজার ৬৪২ আর ২৯ ডিসেম্বর এক হাজার ৮০৪ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো হয়। সেখানে পর্যায়ক্রমে এক লাখ রোহিঙ্গাকে পাঠানো হবে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর ধারণা ছিল, বর্ষা, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় ভাসানচর এলাকা ডুবে যেতে পারে। সে কারণে দ্বীপটি বসবাসের অনুপযোগী বলে তাদের ধারণা। একইসঙ্গে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জোর করে পাঠানো হচ্ছে বলেও দাবি করে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশেষ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে এমনটাই দাবি করা হয়েছে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়েছে, ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে দ্বীপটির কোনো ক্ষতি হয়নি। দ্বীপটি ৩০ বছরের পুরোনো। সেখানে আগে থেকেই মানুষজন ছিল। দ্বীপটি পুরোপুরি নিরাপদ। স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারাও নিরাপদে থাকবেন। এছাড়া কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে সেখানে পাঠানো হচ্ছে না।
প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি টাকায় নির্মিত রোহিঙ্গাদের জন্য এই আবাসন প্রকল্পে এক লাখ এক হাজার ৩৬০ জন শরণার্থী বসবাস করতে পারবেন। সেখানে ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ঘরের সংখ্যা এক হাজার ৪৪০টি। প্রতিটি ঘরে প্রতি পরিবারের চারজন করে মোট ১৬টি পরিবার বসবাস করতে পারবে। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউজের এক প্রান্তে বসবাসকারী পরিবারের নারী-পুরুষদের জন্য আলাদা গোসলখানা ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং অন্য প্রান্তে রান্নাঘরও রয়েছে। রয়েছে বিদেশি প্রতিনিধিদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা।
এনআই/এফআর