জিয়ার পথ ধরে এরশাদ, একধাপ ওপরে খালেদা

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের পথ ধরে জেনারেল এরশাদ এবং তারপর তাদের থেকে আরও এক ধাপ ওপরে গিয়ে খালেদা জিয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করেছে।
রোববার (১ আগস্ট) আসন্ন ‘জাতীয় শোক দিবস’ উপলক্ষে বাংলাদেশ কৃষক লীগ আয়োজিত ‘স্বেচ্ছায় রক্ত ও প্লাজমা দান’ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এমন অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ৭৫ এর ১৫ আগস্ট এ দেশে ঘটে গিয়েছিল আরেকটি কারবালা। সেদিন আজকে যেখানে বসে আপনারা প্রোগ্রাম করছেন সেখানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে। শুধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল তা নয়, একটি আদর্শকে হত্যা করা, বিজয়কে নস্যাৎ করা, জাতি হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার যে সুযোগ সেটাকে ধ্বংস করে দেওয়া- এটাই ছিল ঘাতকদের প্রচেষ্টা।
তিনি বলেন, ক্ষমতা দখলের জন্য শুধু রাষ্ট্রপতিকেই হত্যা করেনি, জাতির পিতার কেউ যেন আর কখনো এদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে না পারে, তাই সেদিন আমার মা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে হত্যা করে। যে সব সময় ছায়ার মতো আমার বাবার পাশে ছিলেন। শুধু সংসার চালানো নয়, পর্দার আড়ালে থেকে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিলেন। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে যার বিরাট অবদান ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল একটাই। বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ধ্বংস করা। বিজয়কে ধ্বংস করা। তাই সেই হত্যাকাণ্ডের পর পর যে বাংলাদেশের নাম মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেওয়া হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, সেই দেশের নাম পাল্টে ইসলামিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ করা হয়েছিল। যদিও সেটা টেকাতে পারেনি। যদিও ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটা বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেয়নি। বাংলাদেশ বেতারের নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল, পাকিস্তানে ঠিক যেভাবে যে কায়দায় ছিল, প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিক সেভাবে করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ যারা হতদরিদ্র ছিল, তাদের পরনে ছিন্ন কাপড়, পেটের ক্ষুধার জ্বালা মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, রোগের চিকিৎসা নেই, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত- এই শোষিত-বঞ্চিত মানুষগুলোর জীবনকে উন্নত করা, ভাগ্যের পরিবর্তন করে দিয়ে তাদের একটা সুন্দর জীবন দেওয়া, উন্নত জীবন- এটাই ছিল তার লক্ষ্য। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ক্ষুধার্ত দরিদ্র মানুষগুলোর অবস্থা দেখেছিলেন। তখন থেকেই এ মানুষগুলোর জন্য কিছু একটা করার প্রেরণা বা আবেদন ছিল।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, বাংলাদেশকে তিনি স্বাধীন করেন। পাকিস্তানি শাসকচক্র বা এদেশের কিছু দালাল চক্র, তাদের তোষামোদকারী কিছু গোষ্ঠী কেন জানি বাঙালির এই অভ্যুদয় বা বাঙালির এই যে বিজয় এটা কখনো মেনেই নিতে পারেনি। দুঃখজনক হলো যে নিজের দলের ভেতরে খন্দকার মোশতাক যেমন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। আবার অনেকেই তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।
সরকার প্রধান বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে কিন্তু সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়ে যায়। পাকিস্তানের একটি প্রদেশ ছিল। সে প্রদেশটাকে জাতির পিতা স্বাধীন করে বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাঙালি জাতির কল্যাণের জন্য সব সময় তিনি যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন।
তিনি বলেন, বাঙালি জাতিকে যে কেউ কখনো দাবায়ে রাখতে পারবে না এটা তো ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলে গিয়েছিলেন। যে ভাষণ পনেরোই আগস্টের পর এদেশে নিষিদ্ধ ছিল, আজকে সে ভাষণ সারা বিশ্ব ঐতিহ্যে সবথেকে উদ্বুদ্ধকারী একটা ভাষণ হিসেবে স্থান পেয়েছে। সেখানেই তিনি এই বিজয়ের কথা বা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কথা, সবই তিনি বলে গিয়েছিলেন। বাঙালি জাতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সে বিজয় নিয়ে আসে। আর সেই বিজয় নস্যাৎ হয় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমার বাবার অগাধ বিশ্বাস ছিল বাংলাদেশের মানুষের ওপর। তিনি সবসময় বিশ্বাস করতেন বাঙালি কখনো তার গায়ে হাত দিতে পারবে না। পাকিস্তান যখন চেষ্টা করে তাকে হত্যা করতে পারেনি আর বাঙালিরা কেন মারবে? অনেকেই অনেকভাবে তাকে খবর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি কখনো বিশ্বাস করেননি। যখনই কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান বলেছেন তখন তিনি একটা কথাই বলেছেন, এরা আমার সন্তানের মতো, ওরা কেন আমাকে মারবে?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান তাদের (বঙ্গবন্ধুর খুনিদের) বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়। ব্যবসা করার সুযোগ দেয়। বিপুল অর্থের মালিক করে দেয়। জিয়ার পথ ধরে আমরা দেখেছি জেনারেল এরশাদ এই খুনিদের রাজনীতি করার সুযোগ দেয়। রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হবার সুযোগ দেয়। এমনকি ভোট চুরি করে পার্লামেন্টেও মেম্বর করে। তার থেকে একধাপ ওপরে গিয়ে খালেদা জিয়া। এই খুনি রশিদকে ভোট চুরি করে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে পার্লামেন্টে বসায় বিরোধী দলের নেতার চেয়ারে। আরেক খুনিকে পার্লামেন্টে মেম্বর করে। তাদের পুরস্কৃত করে।
তিনি বলেন, ৯৬ সালে আমরা যখন সরকারে আসি, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করে এই খুনিদের বিচারের পথে নিয়ে এসে বিচার কাজ শুরু করি। যেদিন বিচারের প্রথম রায়টা হবে, ৮ নভেম্বর, খালেদা জিয়া বিরোধী দলে, তখন হরতাল ডেকেছিল। যেন কোনো মতে জজ সাহেব কোর্টে যেতে না পারেন, আর বিচারের রায় দিতে না পারেন।
শেখ হাসিনা বলেন, সেই বিচারের রায় হয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে সেই বিচারকাজ তো শুধু বন্ধই করে নাই, অনেক আসামিকে পুনরায় দূতাবাসে চাকরি দেয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দেয়।
তিনি বলেন, ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে এই খুনিদের আবার পৃষ্ঠপোষকতা করে। দেশের ভেতরে এই ধরনের কর্মকাণ্ড এটাই প্রমাণ করে। শুধু তাই না, যুদ্ধাপরাধের বিচারও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুরু করেছিলেন, অনেকে সাজাপ্রাপ্ত ছিল। অনেকে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনে, নাগরিকত্ব ফেরত দেয়।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, সারা বাংলাদেশে যারা যুদ্ধাপরাধী, খুনি, একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারী, তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর আমরা দেখেছি স্বাধীনতা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী, তারাই কিন্তু মূলত ক্ষমতা দখল করে।
তিনি বলেন, ৭৫ এর পনেরোই আগস্টের পর যারা ক্ষমতায় এসেছে তাদের চিন্তা ভাবনা কার্যক্রম যদি পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে দেখবেন, একই, তাদের মধ্যে মিলে যায়। তারাও ভেবেছিল এই বাংলাদেশ কোনোদিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আর যাতে না দাঁড়াতে পারে সেই জন্যই বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আমার এটাই অবাক লাগে, এর সঙ্গে আমাদের যারা তারা কীভাবে জড়িত থাকল?
এইউএ/এসএম/জেএস