বিপদে পড়ে ভারতে গিয়ে দেশে ফিরে আরেক বিপদ

মাস দুয়েক আগে স্ত্রী যমুনা রানী স্বরের চিকিৎসা করাতে ভারত গিয়েছিলেন সাতক্ষীরার হারান চন্দ্র স্বর। যমুনা চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভারতে মারা যান। এরপর স্ত্রীর লাশ ভারতেই সৎকার করে দেশে ফিরে শোকের পাথর বুকে নিয়ে হোটেলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোয়োরেন্টাইনে থাকতে হচ্ছে হারানকে।
স্ত্রীকে সৎকার করার দিনচারেক পর হাইকমিশন থেকে অনাপত্তিপত্র (এনওসি) নিয়ে, করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট দেখিয়ে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ফেরেন তিনি। এখন চেকপোস্ট এলাকার সিটি আবাসিক হোটেলে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে আছেন। স্ত্রী শোকে কাতর ৮০ বছর বয়সী হারান কোয়ারেন্টাইনে একাকী থাকতে থাকতে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
হারান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মেয়ের জামাইয়ের থেকে টাকা নিয়ে স্ত্রীকে ভারতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাই। অসুস্থ স্ত্রী সেখানে মারা যান। এরপর সব কাগজপত্র নিয়ে দেশে ফিরলে আমাকে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন দেওয়া হয়। আমি ওদের বারবার বলেছি, আমার স্ত্রী মারা গেছে; আমার পক্ষে একা থাকা সম্ভব না। আমাকে আমার মেয়ের কাছে বাড়িতে পাঠান, আমার খুব কাছের মানুষের সঙ্গ দরকার। কিন্তু তারা মানেনি। একটা মানুষ নেই আমাকে সান্ত্বনা দেবে। আরও দুদিন বাকি আছে। আমি খুব অসুস্থ। আর পারছি না।’
ভারত থেকে দেশে ফিরে একই হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে আছেন মুন্তাজীর সর্দার। মুন্তাজীর জানান, তিনি ডায়াবেটিস রোগী। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তার প্রতিদিন ৪৫ মিনিট হাঁটা জরুরি। কিন্তু জায়গার স্বল্পতায় হাঁটতে পারছি না। তাছাড়া হোটেলের খাবারেও খুব সমস্যা হচ্ছে। মনে হচ্ছে জেলখানায় বন্দি।
করোনা পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে ভারত থেকে দেশে ফেরাদের ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন করতে হচ্ছে। এতে বৃদ্ধ ও রোগীদের পড়তে হচ্ছে নানা সমস্যায়। অনেক বৃদ্ধ ও রোগী চিকিৎসা নিয়ে ফিরে কোয়ারেন্টাইনে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কোয়ারেন্টাইনের হোটেলগুলোতে চিকিৎসা ও খাবারের মান নিয়েও আপত্তি রয়েছে অনেকের। আবার অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অনেকে ১৪ দিনের হোটেলসহ অন্যান্য খরচ মেটানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।
তবে তাদের অভিযোগে সঙ্গে মেলে না শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মীর আলিফ রেজার কথা। আলিফ রেজা বলেন, ‘ভারত থেকে যারা দেশে ফিরছেন তাদের খুব ভালো সেবা দেওয়া হচ্ছে। তাদের স্থলবন্দর থেকে হোটেলগুলোতে পাঠাতে গাড়ি আমরা ঠিক করে দিচ্ছি। যেসব হোটেলে কোয়ারেন্টাইন করানো হচ্ছে, অর্ধেক ভাড়ায় আমরা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কোয়ারেন্টাইন শেষে কেউ টাকার কারণে বাড়ি যেতে না পারলে, তাদের ভাড়া দেওয়ার ব্যবস্থাও করছি। যাদের হোটেলে কোয়ারেন্টাইন করতে সমস্যা হচ্ছে, তারা আমাদের জানালে বেনাপোল স্থলবন্দরের পাশে আমরা বিনা খরচে গাজীর দরগাহ নামক মাদ্রাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দেব।’
তবে কোয়ারেন্টাইনে যারা আছেন তারা সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন, তাদের করোনা পরীক্ষার ফল পজিটিভ থাকলে যেন হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। প্রয়োজনে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর পর সরকারি ব্যবস্থাপনায় নজরদারিতে থাকতে রাজি আছেন তারা।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস বলেন, ‘আমাদের নিজেদের লোকজনের কথাও চিন্তা করতে হবে। যারা যাচ্ছেন, উনারা কিন্তু বলে যাচ্ছেন। অঙ্গীকারনামা দিয়ে যাচ্ছেন এসে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন করবেন। সব শর্ত মেনেই কিন্তু তারা সেখানে যাচ্ছেন।’
ভারতে করোনার প্রকোপ ব্যাপক হারে বাড়তে থাকলে গত এপ্রিলের শেষের দিকে দেশটির সঙ্গে সব ধরনের স্থলসীমান্ত বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এতে দেশটিতে চিকিৎসাসহ নানা ধরনের কাজে যাওয়া বাংলাদেশিরা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আটকা পড়ে। এ অবস্থায় শর্তসাপেক্ষে আটকাপড়া বাংলাদেশিদের দেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়।
এদিকে, ‘এয়ার বাবল’ চুক্তির আওতায় শিগগিরই ভারতের সঙ্গে ফ্লাইট চালু করতে চায় সরকার। ভারত সরকারের সম্মতি ফেলেই শুরু হবে ফ্লাইট। তবে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় সীমিত আকারে সপ্তাহে একটি বা দু’টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে। ফ্লাইটের ক্ষেত্রেও স্থলসীমান্ত দিয়ে দেশে ফেরার সময় যেভাবে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন করতে হয় ঠিক একই নিয়ম বলবৎ থাকবে।
এনআই/এনএফ