রোহিঙ্গা ইস্যুতে ঢাকায় বসছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-চীন

বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসছে চীন।
তিন দেশের সচিব পর্যায়ে বৈঠকটি আগামী ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে।
বুধবার (১৩ জানুয়ারি) রাজধানীর লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে সুরের ধারার আয়োজনে ‘পৌষ উৎসব-১৪২৭’ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করেছেন। সফর শেষে তিনি আমাদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের জন্য বলেছেন। আমরা বলেছি, সমস্যা নেই বসেন। আগামী ১৯ জানুয়ারি তিন দেশের সচিব পর্যায়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন
এর আগেও চীনের তত্ত্বাবধানে প্রত্যাবাসন বিষয়ে বসেছিল ঢাকা ও নেইপিদো। কিন্তু তাতে কোনো ফল মেলেনি। এবারের বৈঠক নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘বৈঠকে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হবে। আমরা সবসময় আশাবাদী। আমাদের বিশ্বাস রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফিরে যাবেন।’
অতীতে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা ফিরে গেছেন জানিয়ে মোমেন বলেন, ‘আমরা দেখেছি, আগেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে। ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়েছে। এখন যারা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন তাদেরও তারা ফেরত নেবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। আমরা সব সময় আশাবাদীদের দলে। কারণ রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে তো ফেরত যেতেই হবে।’
এর আগে ২০১৯ সালে চীনের উদ্যোগে প্রথম ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসেছিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। সেই বৈঠকের পর নেইপিদোর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও এখনও একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
চীনের আন্তরিকতার কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি বলে পূর্বের ন্যায় চীনের সমালোচনা করেন মোমেন। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার আমাদের বলছে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাবে কিন্তু নেয় না।’
গত ২২ অক্টোবর চীনের পক্ষ থেকে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের বিষয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বার্তা আসে। সেদিন সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সঙ্গে টেলিফোন আলাপ করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।
ফোনালাপের আলোচ্য বিষয় ছিল প্রত্যাবাসন ইস্যু। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে খুব দ্রুতই আলোচনায় বসতে চায়। এ নিয়ে দেশটির নির্বাচনের পর প্রথমে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মন্ত্রীপর্যায়ের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে মোমেনকে আশ্বস্ত করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ঢাকায় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পর্যায়ের প্রস্তুতিমূলক ত্রিপক্ষীয় বৈঠক দ্রুত শুরু করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন ওয়াং ই।
টেলিফোন আলাপে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনকে জানান, চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে চলেছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কীভাবে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফেরত নেওয়া যায় সে জন্য মিয়ানমার কাজ করবে বলে চীনকে আশ্বস্ত করেছে।
সদ্য শেষ হওয়া বছরের নভেম্বরে মিয়ানমারের নির্বাচন শেষ হলেও চলতি বছরের এপ্রিলের আগে দেশটির সরকার গঠন করা অবধি চীনের পক্ষ থেকে কোনো বার্তা না আসায় উদ্বিগ্ন ছিল ঢাকা। কারণ ঢাকা খুবই দ্রুতই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে চায়। ঢাকার এই উদ্বেগের মধ্যে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে আগামী ১৯ জানুয়ারি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের বার্তা এলো।
এদিকে, বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে নতুন করে আরও দুই লাখ ৩০ হাজার জনের তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এর মধ্যে ২৮ হাজার জনকে নিজেদের নাগরিক বলে স্বীকার করেছে দেশটি। তালিকার ১৪ হাজার জনের তথ্য তাদের ডাটাবেজেই নেই বলে জানিয়েছে মিয়ানমার।
এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ঢাকা পোস্ট-কে জানান, সম্প্রতি মিয়ানমারকে এই তালিকা হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। দুই লাখ ৩০ হাজারের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা যাচাই-বাছাই করে সেখান থেকে ২৮ হাজার জনকে তাদের বাসিন্দা বলে স্বীকার করেছে মিয়ানমার। এদের মধ্যে ১৪ হাজার রোহিঙ্গার নাম দেশটির ডাটাবেজেই নেই বলে ঢাকাকে জানিয়েছে নেইপিদো।
যাচাই-বাছাই করাদের মধ্যে ৩৫০ জনকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তালিকা গ্রহণ করা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের ভাষ্য জানতে চাইলে জ্যৈষ্ঠ এ কর্মকর্তা বলেন, ‘মিয়ানমারতো এর আগেও তালিকা নিয়েছে, কিন্তু একজনকেও ফিরিয়ে নেয়নি।’
এ বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের পক্ষ থেকে নতুন করে রোহিঙ্গাদের তালিকা গ্রহণ করার বিষয়টি ইতিবাচক। তবে পূর্ব অভিজ্ঞতায় বিষয়টি বাংলাদেশকে স্বস্তি দিচ্ছে না বলেও ভাষ্য বিশ্লেষকদের।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া শুরু করেন। বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে, প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত হিসেবে রয়েছেন। এরপর থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে প্রথমবারের মতো ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে আট হাজার ৩২ জনের তালিকা দেওয়া হয়। দ্বিতীয়বার ২২ হাজার ৪৩২ জনের তালিকা দেওয়া হয় একই বছরের অক্টোবরে। এরপর ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট চার দফায় মিয়ানমারকে এক লাখ ছয় হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দেয় বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেটি আজও শুরু হয়নি।
গত বছর দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা।
এদিকে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করেছে সরকার। সেখানে দুই দফায় তিন হাজার ৪৪৬ জন রোহিঙ্গাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গত ৪ ডিসেম্বর এক হাজার ৬৪২ আর ২৯ ডিসেম্বর এক হাজার ৮০৪ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো হয়। সেখানে পর্যায়ক্রমে এক লাখ রোহিঙ্গাকে পাঠানো হবে।
এনআই/এফআর