‘তোমরা কে আছ আমার স্বামীকে এনে দাও’

জলজ্যান্ত মানুষটা সকালে ঘর থেকে বের হয়েছে অফিসের কাজে। মানুষটার কী হলো! আমার স্বামী কই? মানুষ এগুলো কি বলছে, আমার স্বামী নাকি মারা গেছে। এসব মিথ্যা কথা, তাকে তোমার এনে দাও!
রাজধানীর গুলশান-২ এর এম্পোরি ফিনান্সিয়াল সেন্টারে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা সেন্টারের সেন্ট্রাল এসি বিস্ফোরণে নিহত আজিজুল হকের স্ত্রী উর্মি বেগম (২৫) ঘটনাস্থলে এভাবেই বেদনার্ত আহাজারি করছিলেন।
আজিজুল হক ‘আজিজ ট্রেড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সিনিয়র টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করতেন। ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার বাসিন্দা আজিজুল স্ত্রীসহ এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে রাজধানীর শাহাজাদপুর এলাকায় থাকতেন।

বুধবার (১৩ জানুয়ারি) দুপুর ১টার দিকে রাজধানীর গুলশান-২ এর এম্পোরি টাওয়ারে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা সেন্টারের সেন্ট্রাল এসির যান্ত্রিক ত্রুটি এক সহযোগী নিয়ে মেরামত করতে আসেন আজিজুল।
পরে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এসি বিস্ফোরণ হয়। এ সময় আজিজুল ১৪ তলা ভবনের ছাদে সেন্ট্রাল এসির আউটবক্সের মেরামতের কাজ করছিলেন। বিস্ফোরণে আজিজুল ঘটনাস্থলেই নিহত ও তার সহযোগী আহত হন। বিস্ফোরণের ঘটনায় ভিসা সেন্টারের ছয় কর্মকর্তা আহত হয়েছেন বলে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানায়।
আহতদের গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। নিহতের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
এদিকে খবর পেয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন তার স্ত্রী উর্মি বেগম।

স্বামী মারা যায়নি বিস্ফোরণে সামান্য আহত হয়েছেন- উপস্থিত লোকজনের এই কথা বিশ্বাস করেন উর্মি বেগম। পরে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে যখন জানতে পারেন যে তার স্বামী বিস্ফোরণে মারা গেছেন তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারনেনি।
তখন বার বার দৌড়ে বিধ্বস্ত ভবনের ভেতরে স্বামীকে খুঁজতে যেতে যান উর্মি। পুলিশ ও স্বজনদের বাঁধায় ভেতরে যেতে পারননি তিনি। কেউ আটকাতে পারছিল না উর্মিকে।
আমার স্বামী কই। মানুষ এসব কি বলছে আমার স্বামী নাকি মারা গেছে। জলজ্যান্ত মানুষটা সকালে ঘর থেকে বের হয়েছে। মানুষ মিথ্যা কথা বলছে আমার স্বামী মারা যায়নি। তোমরা কে আছ আমার স্বামীকে এনে দাও।
নিহত আজিজুল হকের স্ত্রী উর্মি বেগম
উর্মি বেগমের বুকফাটা আহাজারি আর স্বামী হারানোর আত্মচিৎকারে ঘটনাস্থলের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিস্ফোরণে ভিসা সেন্টারের অফিস অর্থাৎ ভবনের নিচতলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তবে নিচে ধ্বংসযজ্ঞ বেশি হলেও ছাদে এসির আউটবক্সের সামনে আজিজুলের লাশ পাওয়া যায়।

জানা যায়, ১৪ তলা ভবনটিতে আরব আমিরাতের ভিসা সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৯টি অফিস রয়েছে। এ ভবনের সব অফিস বর্তমানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে পুলিশ।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা জোন-৩ এর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর নিয়াজ আহমেদ বলেন, প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, ভিসা সেন্টারের সেন্ট্রাল এসিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে আজিজুল ও আরেকজন টেকনিশিয়ান আনে কর্তৃপক্ষ। পরে আজিজুল ও তার সহযোগী ১৪ তলা বিল্ডিংটির ছাদে এসির আউটবক্স মেরামত করতে যান। সেখানে বিস্ফোরণ ঘটলে আজিজুল ছাদেই মারা যায়। আর এই বিস্ফোরণের কারণে ভিসা সেন্টারের ভেতরের ২৫-৩০ ভাগ ধ্বংস হয়ে যায়।
তিনি বলেন, এ বিষয়ের তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে। এখনই সঠিক কারণ বলা যাচ্ছে না। আমরা ঘটনাস্থলে এসে কাউকে আহত পাইনি।
এ বিষয়ে গুলশান ডিপ্লোমেটিক জোনের ডিসি আশরাফুল ইসলাম বলেন, নিহত আজিজুলের বাড়ি ফরিদপুর। স্ত্রীসহ এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে রাজধানীর শাহাজাদপুরে থাকতেন। তিনি এসি টেকনিশিয়ান হিসেবেই কাজ করতেন।

ভিসা সেন্টারের কর্মকর্তা শরিফ আহমেদ বলেন, আমরা প্রথমে ১টা ৪০ মিনিটের দিকে বিকট শব্দ শুনে দ্রুত অফিস থেকে বের হই। বিস্ফোরণে অফিসের কাঁচের গ্লাস ও জিনিসপত্র ধ্বংস হয়ে যায়। এ ঘটনায় আমাদের ছয়জন সহকর্মী আহত হয়েছেন। পরে ছাদের ওপর থেকে টেকনিশিয়ান আজিজুলের লাশ ফায়ার সার্ভিস নামিয়ে আনে।
রাজধানীর গুলশান-২ এর এম্পোরি টাওয়ারে বুধবার (১৩ জানুয়ারি) দুপুরে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় আজিজুল হক নামে একজন নিহত হয়েছেন। তিনি আজিজ ট্রেড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সিনিয়র টেকনিশিয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এমএসি/ওএফ