আস্থার ঠিকানা ছিলেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর কারাগারে বা বাসার বাইরে যেখানেই থাকতেন বঙ্গমাতা একা হাতেই সব সামলাতেন।
সংসার থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহকর্মী, কর্মীদের কাছেও আস্থার ঠিকানা বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব। এমন বর্ণনা উঠে এসেছে দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও ঐক্য ন্যাপের আহ্বায়ক পঙ্কজ ভট্টাচার্য্যের কথায়।
বঙ্গমাতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন। সেই মাতৃরূপা নারী নির্মমভাবে হত্যার শিকার হলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সপরিবারে। এই স্মৃতি ভোলার নয়। যেদিন প্রথম তাকে দেখি আমার মায়ের চেহারা, আমার মায়ের ছবি যেন বসানো তার চেহারা মধ্যে। সেদিন থেকেই তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমার ছিল।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যা যেমন আমাদের জাতীয় জীবনে খুবই কষ্টের এবং মর্মভেদী একটি ঘটনা। শিশু রাসেল সহ বঙ্গমাতার হত্যা, সেইটা আমরা কখনো ভুলবো না। তিনি চিরদিন মা রূপে বাঙালির জীবনে অধিষ্ঠিত থাকবেন। পূজিত হবেন, মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-সম্মান পাবেন, এইটুকু আমার বিশ্বাস আছে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে শুনেছি যেহেতু জেলখানায় দীর্ঘদিন পাশাপাশি ছিলাম। সান্নিধ্য পেয়েছি, দীর্ঘ আলাপ হয়েছে। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে ভাবীর কথা, ছেলে-মেয়েরা কথা। তিনি (বঙ্গবন্ধু) আমাকে এইটুকু বলেছেন, ”আমার বন্ধুবান্ধব এবং শুভাকাঙিক্ষরা তারা তাদের ভাবীর, আমার স্ত্রীর খোঁজ খবর রাখেন। আমি তো জেলের পর জেলে থাকি। একবার বের হই তো আবার জেলে ঢুকি। নিজের বাড়ি এবং শ্বশুর বাড়ির মতো জেলখানায় আমার যাতায়াত। আমার পক্ষে সংসার দেখা, চাহিদা পূরণ করা অনেক সময় সম্ভব হয়নি। সেখানে তোর ভাবী সব সামাল দিয়েছে। এমনকি আমি যেই কর্তব্যগুলো পালন করি সেই কর্তব্যগুলোর মধ্যে গরীব কর্মীদের খোঁজ খবর রাখা”। -সেখানে হাতে কোনো কিছু থাকলে তিনি গরীব কর্মীদের সহায়তা করতেন। মাওলানা ভাসানীকে যেহেতু বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধা করতেন এবং নিজে জামাকাপড় পাঠাতেন। স্বামীর কর্তব্য কাজটি তিনি নিজের কাজ হিসেবে করতেন। এই কথা, কথা প্রসঙ্গে তিনি (বঙ্গবন্ধু) আমাকে বলেছেন।
বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর বাসায় যখনই গেছি, সব সময় দেখা হয়নি হয়তো। একাধিক দিন তার ডাইনিং রুমে দেখা হয়েছে। সকালে যেহেতু গেছি চা নাশতা করার সুযোগ পেয়েছি। খুব সাধারণ বাঙালি নারীর পোশাক-আসাক, সাধারণ জীবনযাপনের ছাপ সব জায়গায় ছিল এবং তার মধ্যে একটা মাতৃত্বের গুণ, একটা মাতৃত্ব ছাপিয়ে উঠতো সব কিছুতেই।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, সামনে বসে বলতেন, কিছু খান। কিছু না খেয়ে যাবেন না। শরীরের দিকে খেয়াল রাখেন। আপনার ভাই তো শরীরের দিকে খেয়াল রাখেন না। খুব সাধারণ শাড়ি পড়তেন। দামি কাপড় পড়তে পারতেন। দামি কাপড় পড়তেন না। সেই বেশে একজন মাতৃস্থানীয় মহিলা। সবার মা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। যারাই যেত তাকে মাতৃজ্ঞানে সমিহ করতো, স্নেহ করতো। এই জায়গায় শ্রদ্ধাশীল না হয়ে পারা যায় না যে সবাইকে তিনি আপন করে নিতেন। কে দূরে থেকে এসেছে, কে কাছে থেকে এসেছে এটা কোনো কথা নয়, সবাইকে তিনি আপ্যায়ন করতেন। এইটা তার একটা বিশেষ গুণ।
তার বর্ণনায় সেদিন মোশতাক বলেছিলেন, ‘আপনার হাতের পান এটা অনবদ্য। এইটা খেলে আমার সাংঘাতিক ভালো লাগে। সেই জন্য ছুটে আসি আপনার হাতের পান খেতে’। এইটা ছিল তার (খন্দকার মোশতাক আহমেদ) অভিনয়।
তিনি বলেন, আমি একদিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেখা করতে গেছি। বঙ্গবন্ধু শুয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পরে কথা বলবেন। আমি ডাইনিং রুমে গিয়ে ভাবীর কাছে বসে চা খাচ্ছি। ভাবী নিজের হাতে বানানো চা আমাকে ঢেলে দিচ্ছেন। আমি বিস্কিট খাচ্ছি। এমন সময় একজন ঘরে ঢুকলেন। তিনি মোশতাক আহমেদ। বিখ্যাত মোশতাক আহমেদ মাথার টুপিটা সযত্নে ধরে উঁচু করে বসলেন। বসেই ভাবীর পানের বাটাটা নিয়ে বললেন, ভাবী আপনার হাতের পান খেতে যা মজা, যা আনন্দ। আপনি একটা পান আমাকে বানিয়ে দেন।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, সরল মানুষ, সরল হৃদয়ের মহিলা। তাকে কীভাবে কাবু করা যায় সেই অস্ত্রটা মোশতাক প্রয়োগ করলো সেই দিন। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পরে বেরিয়ে এলো পেছনের মূল ব্যক্তি মোশতাক। অনেক আগে থেকেই আমরা তাকে সন্দেহ করতাম। কারণ মুজিব নগর সরকারের মধ্যে সে কনফেডারেশন পন্থী পাকিস্তানের সঙ্গে। আর তাজউদ্দীন আহমদ যিনি প্রধানমন্ত্রী, তিনি ছিলেন জাতীয় মুক্তির পথে, স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষে তিনি বদ্ধ পরিকর। এই নিয়ে তিনি (মোশতাক আহমেদ) দুই নম্বর ধারা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তৈরি করলেন। সেই ধারার অনুসারী বলেই সব সময় তার (মোশতাক আহমেদ) একটা তীব্র ঘৃণাবোধ ছিল। সেই কারণে এই অভিনয়টা দেখে মনটা বিষিয়ে উঠেছিল। এত সরল, মাতৃহৃদয়ের মানুষটিকে তিনি কাবু করছেন সুপরিকল্পনার অংশ হিসেবে, সেটা পরবর্তী সময়ে বুঝলাম।
এইউএ/এসএম
