শহরের সুবিধা নিয়ে সারাদেশে ১০ মডেল গ্রাম

‘বঙ্গবন্ধু মডেল গ্রাম’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রকল্পের আওতায় দেশের আটটি বিভাগ থেকে নির্বাচিত ১০টি গ্রামকে মডেল গ্রাম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে সমবায় অধিদপ্তর। ‘শহরের সব সুবিধা’সহ গ্রামগুলোতে থাকবে উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত নভেম্বরে ৪৯তম ‘জাতীয় সমবায় দিবস-২০২০’ উপলক্ষে ১০টি গ্রামে বঙ্গবন্ধুর বহুমুখী সমবায় ভাবনার আলোকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে মডেল গ্রাম নির্মাণের নির্দেশনা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেয়। সম্প্রতি এ প্রকল্পের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা করেছে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে।
যেসব জেলায় মডেল গ্রাম
পিইসি সভার কার্যপত্রে দেখা গেছে, প্রকল্পটি দেশের আটটি বিভাগের নির্বাচিত জেলাগুলোতে বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, শরিয়তপুর ও টাঙ্গাইল জেলা রয়েছে। ময়মনসিং বিভাগের জামালপুর, চট্টগ্রামের কুমিল্লা, সিলেটের সুনামগঞ্জ, খুলনার যশোর, রাজশাহী, রংপুর এবং বরিশাল জেলায় নির্বাচিত গ্রামে এ প্রকল্পটি পাইলট হিসেবে বাস্তবায়ন করা হবে।
পাইলট প্রকল্প সফল হলে সারাদেশে আরও বড় আকারে প্রকল্প হবে।
সমবায় অধিদপ্তরের যুগ্ম নিবন্ধক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন
এ প্রসঙ্গে সমবায় অধিদপ্তরের যুগ্ম নিবন্ধক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রেক্ষিতে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকল্পটি পাইলট হিসেবে বাস্তবায়ন করব। প্রধানমন্ত্রী আগেও বলেছিলেন, শহরের সুযোগ-সুবিধা গ্রামে পাওয়ার ব্যবস্থা করতে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা প্রথমে ১০টি গ্রামে মডেল গ্রামের পাইলটিংটা করব। যদি সফল হয়ে যাই, তাহলে সারাদেশে আরও বড় আকারে প্রকল্প নেওয়া হবে। শহরের মতো না হলেও যেন শহরের কাছাকাছি পর্যায়ের সব সুযোগ-সুবিধা গ্রামে পৌঁছাতে পারি সে ব্যবস্থা করা হবে পাইলট বেসিস প্রকল্পে।
পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে এখনও ৬০ ভাগ লোক গ্রামে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন বহুলাংশে পল্লী উন্নয়নের ওপর ভরসা করতে হয়। বঙ্গবন্ধুও কৃষি ও পল্লী উন্নয়নকে সামগ্রিক উন্নয়নের মূলশক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং সে লক্ষ্যে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন।
• বঙ্গবন্ধুকে সর্বোচ্চ সম্মান জানিয়ে প্রকল্প।
• ব্যয় ধরা হয়েছে, ৪৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
• ১০টি গ্রামের কৃষি খাতে ২৫ শতাংশ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে।
• ১০ হাজার লোককে দক্ষভাবে গড়ে তুলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে।
• ১০টি সমবায় সমিতি গঠন করা হবে।
• প্রায় ৫ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ১০টি কমিউনিটি ভবন নির্মাণ করা হবে।
• পাইলট প্রকল্প সফল হলে সারাদেশে আরও বড় আকারে প্রকল্প হবে।
বঙ্গবন্ধুকে সর্বোচ্চ সম্মান জানিয়ে সমবায় অধিদপ্তর ‘আমার শহর আমার গ্রাম’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পে গ্রামের বৈশিষ্ট্য সমুন্নত রেখে গ্রামীণ সম্পদের সুষ্ঠু ও সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করা, গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষির আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণ এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ ও বাজার অবকাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
প্রকল্পের ব্যয়
প্রকল্পের ডিপিপিতে দেখা গেছে, ‘বঙ্গবন্ধু গণমুখী সমবায় ভাবনার আলোকে বঙ্গবন্ধু মডেল গ্রাম প্রতিষ্ঠা পাইলট’ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে, ৪৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদনের পর প্রকল্প জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২২ সালে বাস্তবায়ন করবে সমবায় অধিদপ্তর।
সমবায় মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে ১০টি গ্রামের কৃষি খাতে ২৫ শতাংশ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে। মধ্যম আয়ের দেশ থেকে পর্যায়ক্রমে উন্নত দেশের মর্যাদার সাথে সামঞ্জপূর্ণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষভাবে ১০টি গ্রামের ১০ হাজার লোককে দক্ষভাবে গড়ে তুলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। প্রত্যাশিত আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হিসেবে ১০টি সমবায় সমিতি গঠন এবং প্রায় ৫ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ১০টি কমিউনিটি ভবন নির্মাণ করা হবে।
প্রকল্পের কার্যক্রম
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হচ্ছে- বঙ্গবন্ধুর আর্দশের ১০টি গ্রাম সমবায় সংগঠিত করা, কৃষি উৎপাদনের যান্ত্রিক ও উত্তম পদ্ধতি প্রচলন করা, ১০টি গ্রামে ২টি ১ একর পুকুরে মৎস্য চাষ ও প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ২টি গরু পালন মডেলের মাধ্যমে আধুনিক ও উত্তম পদ্ধতির প্রচলন, গ্রামীণ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্জাগরণ ও গ্রামীণ দারিদ্য কমানোসহ ইত্যাদি কাজ করা হবে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভগের সদস্য জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, প্রকল্পটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয়েছে। যার ফলে পিইসি সভাসহ অনুমোদনও তাড়াতাড়ি হবে। পাইলটিংয়ে সফল হলে প্রকল্পটি দেশব্যাপী বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী শহর ও গ্রামের বৈষম্য কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছেন। বলতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর অন্যান্য উদ্যোগের মধ্যে এটা অন্যতম। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে গ্রামের সঙ্গে শহরের দূরত্ব অনেক কমবে বলে আমি আশা করি।
পিইসি সভায় পরিকল্পনা কমিশনের মতামত
পিইসি সভায় প্রকল্পটির ওপর পরিকল্পনা কমিশন মতামত দিয়ে বলেছে- প্রকল্পের উদ্দেশ্যে ১০টি সমবায় সমিতি গঠন ও ৫ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ১০টি কমিউনিটি ভবন নির্মাণের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যা উদ্দেশ্যের পরিবর্তে প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
প্রস্তাবিত ডিপিপিতে অন্যান্য ভবন ও অবকাঠামো খাতে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষে ১০টি কমিউনিটি ভবন নির্মাণে ৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ আছে। ভবনগুলো নির্মাণে ১ বিঘা করে জমির প্রয়োজন। এজন্য কোনো জমি অধিগ্রহণ করা হবে কি না তা উল্লেখ নেই। জমি অধিগ্রহণ করা না হলে জমির সংস্থান বিষয় ডিপিপিতে উল্লেখ করতে হবে।
দুইতলা বিশিষ্ট ১০টি কমিউনিটি ভবনের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণে ‘বিল অব কোয়ানটিটি’ ধরে নির্মাণ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। স্যানিটারী, বৈদ্যুতিক কাজ, রাস্তা নির্মাণ, সীমানা প্রাচীরের ব্যয় প্রাক্কলন একইভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সাধারণত প্রকল্পের ডিপিপি পর্যায়ে এরিয়া রেইট বিবেচনায় নিয়ে ভবনের ব্যয় প্রাক্কলন যাচাই করা সহজ হয়। সে হিসেবে ডিপিপিতে প্লিন্থ এরিয়া রেইট ধরে বিস্তারিত ব্যয় প্রাক্কলন সংযোজন করতে হবে।
দারিদ্র পরিস্থিতি বিশ্লেষণে অতি দারিদ্রের হার ১২ শতাংশ উল্লেখ করা হয়েছে, যা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন।
প্রস্তাবিত ডিপিপি’র সংযোজনী-১ এ প্রকল্পের এলাকাভিত্তিক ব্যয় বিভাজনে প্রকল্প দপ্তর ঢাকায়, প্রশিক্ষণ, সরবরাহ ও সেবা, ক্রয় ও সংগ্রহ বাবদ ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। হায়ারিং চার্জ (প্রকল্পের গাড়ি) বাবদ ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এগুলোর যৌক্তিকতার বিস্তারিত জানাতে হবে।
ডিপিপিতে জরিপ খাতে ২৪ লাখ টাকা প্রস্তাব ও কনসালটেন্সি ফার্ম নিয়োগের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। এ প্রকল্পে জরিপের প্রয়োজনীয়তা ডিপিপিতে যুক্ত করতে হবে।
মোটরযান খাতে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম খাতে ৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, সেচ অবকাঠামো খাতে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এগুলো কোথায়, কীভাবে ব্যবহার হবে তা স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
ডিপিপিতে উদ্বুদ্ধকরণ, দক্ষতা উন্নয়ন, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ ব্যয় বাবদ ২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা রয়েছে। সেমিনার, কনফারেন্স ব্যয় বাবদ ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের হালনাগাদ পরিপত্র অনুসরণ করা হয়েছে কি না বিষয়টি যুক্ত করতে হবে। এছাড়া এ প্রকল্প অঞ্চলে চলমান অন্যান্য প্রকল্পের কার্যক্রমের সঙ্গে এর কার্যক্রমের দ্বৈততা পরিহার সংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র নেই, যা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
এসআর/এইচকে