জঙ্গিবাদ ছেড়ে আলোর পথে তারা

জঙ্গিবাদ দমনে ধারাবাহিক অভিযানের পাশাপাশি তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এরই ধারাবাহিকতায় বিভ্রান্ত মতাদর্শ, মত ও পথ ছেড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোর পথে ফিরেছেন ৯ জঙ্গি। যারা বিভ্রান্ত হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) বেলা ১২টায় রাজধানীর র্যাব সদর দপ্তরে ‘নব দিগন্তের পথে’ শীর্ষক আয়োজিত অনুষ্ঠানে নয় জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেন। এদের মধ্যে ছয়জন জেএমবি ও তিনজন আনসার আল ইসলামের সদস্য ছিলেন।
অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এ সময় মন্ত্রী ফিরে আসা নয়জনকে তাদের অভিভাবকের হাতে তুলে দেন ও তাদের পুনর্বাসনের জন্য সহায়তা প্রদান করেন।
আত্মসমর্পণ করা জঙ্গিরা হলেন- শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত (৩৪), ডা. নুসরাত আলী জুহি (২৯), আবিদা জান্নাত আসমা (১৮), মোহাম্মদ হোসেন ওরফে হাসান গাজী (২৩), মো. সাইফুল্লাহ (৩৭), মো. সাইফুল ইসলাম (৩১), মো. আবদুল্লাহ আল মামুন (২৬), মো. সাইদুর রহমান (২২) ও আবদুর রহমান সোহেল (২৮)।
জঙ্গিবাদ একটা বিশ্বাস ও ধারণা। শুধু বন্দুকের মাধ্যমে এটি চিরতরে নির্মূল সম্ভব নয়। জঙ্গিবাদ সমূলে উৎপাটনের জন্য একটা বাতায়ন খুলে দেওয়া হয়েছে। যেন তারা ভুল পথ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন।
র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন
এরই ধারাবাহিকতায় নয়জন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে র্যাবের কাছে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং জানায়, শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত সিলেটের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অধ্যায়নকালীন সময়ে হিযবুত তাহরীরে যুক্ত হন। পরবর্তীতে হিযবুত তাহরীরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় শীর্ষপর্যায়ে চলে যান। ২০০৯ সালে তিনি আনসার আল ইসলামে যোগ দেন। এরপর ২০১১ সালে মেডিকেল শিক্ষার্থী ডা. নুসরাতকে বিয়ে করেন ও স্ত্রীকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেন।

পরবর্তীতে সংগঠনের নির্দেশনায় ঢাকায় চলে আসেন। ২০১৭ সাল থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার আতঙ্কে তিনি ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বাসা বদলাতে থাকেন। এক পর্যায়ে ঢাকার আশেপাশের এলাকায় বসবাস শুরু করেন।
ডা. নুসরাত আলী জুহি সিলেটের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় উল্লেখিত আনসার আল ইসলামের সদস্য শাওনের সঙ্গে বিবাহ হয়। বিবাহটি সাংগঠনিক অনুমোদনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। মূলত স্বামী শাওন তাকে উগ্রবাদের দিকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। স্বামীর সঙ্গে তিনি সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতেন। জঙ্গিবাদে জড়িত হওয়ায় ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালে তিনি পরিচয় গোপন রেখে খণ্ডকালীন চাকরি করেছেন।
জঙ্গিবাদের অনুসারী হওয়ার কারণে শাওন ও নুসরাত দীর্ঘদিন ফেরারি জীবনযাপন করেন। এতে তাদের দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ শঙ্কায় পড়ে। স্বজনদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তারা র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের ইচ্ছা করেন। শাওনের অসমাপ্ত শিক্ষা জীবন সম্পূর্ণ করা ও ডা. নুসরাতের বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে পূনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করে র্যাব।
আত্মসমর্পণকারী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সাইদুর রহমান উগ্রবাদী ভিডিও দেখে জেএমবির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়। নিজ এলাকার একটি বাড়িতে তারা বায়াত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তারা ঢাকায় এসে আত্মগোপন করেন। জঙ্গিবিরোধী অব্যাহত অভিযানে তাদের বহু সঙ্গী আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ের। এসময় পরিবার, আত্মীয় ও বন্ধুদের থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে নিজ বাড়ীতেও অবস্থান করতে পারেনি।
আত্মগোপনে থেকে তারা উপলব্দি করে এ জীবন কোন সুস্থ মানুষের জীবন হতে পারে না। তারা তাদের ভুল বুঝতে পারেন। তারা উভয়েই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।
আব্দুর রহমান সোহেল পেশায় একজন শিক্ষক। তিনিও জেএমবির আদর্শের অনুপ্রাণিত হন। তিনি ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানার একটি জঙ্গি মামলায় গ্রেফতার হন। ২০১৮ সালে জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় জেএমবির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন। তার বিরুদ্ধে পুনরায় ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়ায় আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু ফেরারি জীবনে পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। একপর্যায়ে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।

আবিদা জান্নাত আসমা উগ্রবাদে আকৃষ্ট হওয়ার পর মা-বাবাকে না জানিয়ে ২০১৮ সালে আনসার আল ইসলামের এক সদস্যের সঙ্গে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফলশ্রুতিতে শুরু হয় স্বামীর সঙ্গে আত্মগোপনের জীবন। একপর্যায়ে স্বজনদের কাছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। পরে শাওনের পরামর্শ অনুযায়ী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।
সাইফুল্লাহ মাদরাসায় অধ্যায়নের সময় সহপাঠীর মাধ্যমে জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি দাওয়াতি কার্যক্রম ও অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। তার কিছু সঙ্গী গ্রেপ্তার হওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান। ফেরারি জীবনযাপনের কারণে তার পারিবারিক জীবনে অশান্তি শুরু হয়। তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এক পর্যায়ে ভুল বুঝতে পারেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।
মোহাম্মদ হোসেন পেশায় রাজমিস্ত্রি। ২০১২ সালে ঢাকায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ শুরু করেন। সাইফুল্লাহর মাধ্যমে তিনি জেএমবির আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। সাইফুল্লার সঙ্গে জেএমবির সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যান। কিন্তু ফেরারি জীবনের অনিশ্চয়তা ও পারিবারিক জীবনে অশান্তি শুরু হলে নিজের ভুল বুঝতে পারেন। তিনি সাইফুল্লাহর সঙ্গে আলোচনা করে র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন।

সাইফুল ২০১৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাস করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি জেএমবিতে যোগ দেন। নিজ এলাকায় ব্যাপক সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোয় জঙ্গি হিসেবে এলাকায় পরিচিতি পান। ইতোমধ্যে জঙ্গি সংগঠনের কিছু সদস্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়ায় তিনি আত্মগোপনে চলে যান। দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকায় তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। পরবর্তীতে র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।
র্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের সভাপতিত্বে জঙ্গি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন, পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রধান খন্দকার ফারজানা রহমান, ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও ইত্তেফাকের সিটি এডিটর আবুল খায়ের।
জেইউ/ওএফ