‘ছেলে জঙ্গি হবে ভাবিনি’

অনেক দিন ছেলে শাওনের মুখে বাবা ডাক শুনিনি, অপেক্ষায় ছিলাম। শাওন বিয়ে করলেও বউকে পর্যন্ত দেখতে পাইনি। কখন ছেলে এবং ছেলের বউকে দেখতে পাবো সেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। আজ সে অপেক্ষা কাটলো। ওদের ফিরে পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত।
জঙ্গিবাদের ভুল পথ ছেড়ে ছেলে শাওন আত্মসমর্পণ করার পর এসব কথা বলেছেন তার বাবা। বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন ৯ জঙ্গি। আজ (বৃহস্পতিবার) দুপুরে র্যাব সদর দফতরে ‘নব দিগন্তের পথে’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা আত্মসমর্পণ করেন।
ছেলেকে ফিরে পেয়ে আবেগাল্পুত শাওনের বলেন, আমার একটি মেয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছে এবং আমার ছেলে ওসমানী মেডিকেল থেকে ডাক্তারি শেষ করে বের হয়েছে। সামাজিকভাবে আমার একটা অবস্থান আছে। আমার সকল ছেলে-মেয়ে মেধাবী। কিন্তু হঠাৎ করে আমার ছেলে শাওন পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। এটা আমি কখনও বুঝতে পারিনি। তার বর্তমান কর্মকাণ্ড পূর্বের কর্মকাণ্ডের সাথে কোনোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
শাওনের ভুলপথে চলে যাওয়ার দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে এই বাবা বলেন, শাওন অনেকদিন ঘরছাড়া ছিল। আমি আমার ছেলের মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে পাইনি। আমি সব সময় স্বপ্ন দেখতাম আমার ছেলে এবং আমার বউমার কোলে বাচ্চা আসবে। এর মধ্যে আমি তাদের ফিরে পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত।
তিনি আরও বলেন, সন্তান বিপথে চলে গেলে বাবা-মা কী কষ্টে থাকে এটা বোঝানো কঠিন। এই অন্ধকার পথ থেকে ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে হলে সবার আগে তার বাবা-মাকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানরা যাতে জঙ্গিবাদের মতো বিপদে না যায় সেজন্য সব থেকে বেশি বাবা-মাকে সতর্ক এবং সজাগ থাকতে হবে।
তিনি বলেন, সহনশীল নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলা একান্ত জরুরি। এর মধ্যে যারা বিপথে চলে গেছে তাদের নতুন জীবন শুরু করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। এজন্য জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে অন্যান্য সংস্থাকেও একসঙ্গে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমি সকল বাবা-মার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, সবাই সন্তানদের প্রতি আরও যত্নবান হোন, আপনার সন্তানের মতামতের ওপর গুরুত্ব দেন, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি সবাইকে বলতে চাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আমরা সবাই যদি সচেতন হই, তাহলে বাংলাদেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব হবে এবং অচিরেই বাংলাদেশ থেকে জঙ্গিবাদ ধ্বংস হয়ে যাবে।
র্যাবের ইন্টেলিজেন্স শাখার প্রধান, অ্যাডিশনাল এসপি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং র্যাবের মহাপরিচালক সবাইকে ধন্যবাদও জানান ছেলে ফিরে পাওয়া এই বাবা।
জঙ্গিবাদ শুধু বন্দুকে নির্মূল সম্ভব নয়: র্যাব এডিজি
এই অনুষ্ঠানে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার বলেছেন, জঙ্গিবাদ একটি ধারণা, বিশ্বাস। এটা হৃদয়ে থাকে। শুধু বন্দুক দিয়ে বা অপারেশন করে যা দূর করা যাবে না।

র্যাবের অতিরিক্ত এই মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা যাদের সন্ত্রাসী বলি, সবাই সন্ত্রাসী নয়। কারো মনে সামান্য সহানুভূতি থাকে... এক পর্যায়ে সাপোর্টার হয়ে যায়। এরপর অ্যাকটিভিস্ট হয়, সে তখনও সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হয়ে যায় না। এরপরের ধাপে এক্সট্রিমিস্ট হয়। এই পর্যায়ে সে অন্য কারো মতাদর্শকে মানতে চায় না। এক্সট্রিমিস্ট হওয়ার পর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। তখন সবাইকে শত্রু মনে করতে থাকে। তার ভ্রান্ত ধারণাকে অবহেলা করা যাবে না। কারণ এটা সে বিশ্বাস করে। তার ধারণায় আঘাত করতে হবে। যেটা শুধুমাত্র বন্দুক দিয়ে সম্ভব নয়। দরকার হয় ডি-রেডিকালাইজেশন। এক্সট্রিমিস্ট থেকে টেররিস্ট হয়ে একজন ব্যক্তি। তখন কোনো একটি নাশকতামূলক কাজের জন্য রওনা দেয়’।
জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে কাজ করছে সরকার: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা শুধু জঙ্গিবাদ কঠোর হস্তে দমন করছি তাই নয়, পাশাপাশি ভুলপথ থেকে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন তাদের ট্রাক্টর, কৃষি উপকরণ, নগদ টাকা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ কখনও জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন জিরো টলারেন্সের কথা। এটা আমরা কখনও বলি না যে, জঙ্গিবাদকে মূলোৎপাটন করেছি। বলেছি, জঙ্গিবাদকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। আমি অনেক দেশেই গিয়েছি। অনেকে প্রশ্ন করে যে, তোমরা কীভাবে জঙ্গিবাদকে মোকাবিলা করছো? বলেছি, বাংলাদেশের জনগণ কখনও জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না বলেই আমরা জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি।
তিনি বলেন, একের পর এক যখন জঙ্গিরা উত্থাপন ঘটাচ্ছিল তখন আমরা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। তখন প্রধানমন্ত্রী দলমত, ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে ডাক দিয়েছিলেন ঘুরে দাঁড়াতে। সবাই সোচ্চার হয়েছে, মানববন্ধন হয়েছে, সমাবেশ হয়েছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। স্কুলের ছাত্রটিও বলেছিল জঙ্গিবাদকে সমর্থন করি না।
জেইউ/এনএফ