সংসদে সব দলের যথাযথ ভূমিকা পালনের আহ্বান রাষ্ট্রপতির

• নিরপেক্ষ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন
• জনজীবনে স্বস্তি বিরাজ করছে
• বাংলাদেশের অবস্থান ও ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়েছে
• সরকার খুব শিগগিরই জনগণকে টিকা দিতে পারবে
• প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দৃশ্যমান পদ্মা সেতু
সরকারি ও বিরোধী দলের সবাইকে মহান জাতীয় সংসদে যথাযথ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
সোমবার (১৮ জানুয়ারি) জাতীয় সংসদের একাদশ অধিবেশনে (শীতকালীন অধিবেশন) দেওয়া ভাষণে তিনি এ আহ্বান জানান।
আবদুল হামিদ বলেন, আমরা আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে। শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে পথে আমরা হাঁটছি, সে পথেই আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। এ বছর মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আমরা ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’ পালন করব।
তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সালে বিশ্বসভায় একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়া। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা একটি কল্যাণমূলক, উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সক্ষম হব।
রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতীয় সংসদ দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। গণতন্ত্রায়ন, সুশাসন ও নিরবচ্ছিন্ন আর্থসামাজিক উন্নয়নে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণি ও পেশা নির্বিশেষে ঐকমত্য গড়ে তোলার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আমি উদাত্ত আহ্বান জানাই।
স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রায় সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধীদলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। আমি সরকারি দল ও বিরোধী দল নির্বিশেষে মহান জাতীয় সংসদে যথাযথ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাই।
আবদুল হামিদ, রাষ্ট্রপতি
রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সুশাসন সুসংহতকরণ, গণতন্ত্র চর্চা ও উন্নয়ন কর্মসূচিতে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারের নিরলস প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে দেশ থেকে দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলের লক্ষ্যে আমাদের আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। আসুন, দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে আমরা লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি।
নিরপেক্ষ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন
তিনি বলেন, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়।
রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ‘রূপকল্প ২০২১’ ও ‘রূপকল্প ২০৪১’ গ্রহণ করে। ৬ষ্ঠ ও ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্টের লক্ষ্যমাত্রাগুলো নির্ধারিত সময়ের আগেই অর্জন করে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের শ্রেণিতে উত্তরণের সব যোগ্যতা অর্জন করেছে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। ইতোমধ্যে সরকার ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়ন শেষে ‘রূপকল্প ২০৪১’ এর কৌশলগত দলিল হিসেবে দ্বিতীয় পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-৪১ প্রণয়ন করেছে। প্রণয়ন করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২১-২৫।
রাষ্ট্রপতি বলেন, 'উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শন ‘রূপকল্প ২০৪১’-এর প্রধান অভীষ্ট হলো ২০৩১ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের অবসান, উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশের মর্যাদায় উত্তরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের অবলুপ্তিসহ উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদায় আসীন হওয়া। আমার দৃঢ় বিশ্বাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার এ লক্ষ্যসমূহ অর্জনে সম্পূর্ণভাবে সক্ষম হবে।'
জনজীবনে স্বস্তি বিরাজ করছে
তিনি বলেন, দেশে আইনের শাসন সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারসহ চাঞ্চল্যকর অন্যান্য মামলার রায় দ্রুত দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালীকরণের পাশাপাশি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দুর্নীতি, মাদক, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে এবং জনজীবনে স্বস্তি বিরাজ করছে।
অভিবাসনসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত
রাষ্ট্রপতি বলেন, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবজনিত কারণে প্রবাস আয় হ্রাসের সম্ভাবনা থাকলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রবাস আয়ে প্রবৃদ্ধির হার ৩৮ শতাংশ, যা অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক। বৈদেশিক শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, দক্ষতা উন্নয়ন, নিরাপদ অভিবাসনসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের অবস্থান ও ভাবমূর্তি আরও গৌরবময়, সুসংহত ও উজ্জ্বল হয়েছে
আবদুল হামিদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্যা কন্যা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অটিজম বিশেষজ্ঞ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্য সায়মা হোসেন ওয়াজেদ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের ‘থিমেটিক অ্যাম্বাসেডর’ হিসেবে মনোনীত হন। এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান ও ভাবমূর্তি আরও গৌরবময়, সুসংহত ও উজ্জ্বল হয়েছে।
সরকার খুব শিগগিরই জনগণকে টিকা দিতে পারবে
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব লাইফ সাইনসেস প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরাসরি ক্রয়ের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় সিএমএসডির মাধ্যমে জরুরিভিত্তিতে ভ্যাকসিন ক্রয় বাবদ ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দেওয়া হয়। আমি আশা করছি সরকার খুব শিগগিরই দেশের জনগণকে কোভিড-১৯-এর টিকা দিতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দৃশ্যমান পদ্মা সেতু
রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে নিজস্ব অর্থায়নে ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’র দুই প্রান্তের মাওয়া ও জাজিরা সংযোগকারী সর্বশেষ ৪১তম স্প্যান স্থাপন করার মাধ্যমে সেতুর ছয় দশমিক এক-পাঁচ কিলোমিটার মূল অবকাঠামো দৃশ্যমান হয়েছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ জুলাই ২০২২ সাল নাগাদ সমাপ্ত হবে। এর ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
এর আগে বিকেল সাড়ে চারটায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের অধিবেশন শুরু হয়। বছরের প্রথম এ অধিবেশনের শুরুতে সভাপতিমন্ডলী নির্বাচন করা হয়। এবার অধিবেশনে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যরা হলেন— নজরুল ইসলাম, আফতাব উদ্দিন সরকার, আব্দুস সালাম মুর্দেশী, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও বেগম মমতাজ। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে এদের মধ্যে অগ্রবর্তীজন অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন।
পরে দেশ-বিদেশে নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, সাবেক সংসদ সদস্য আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন, খালেদুর রহমান টিটো, শাহ-ই-জাহান চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী মোহাম্মদ আবু হেনা, এম হাসেম, আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, দেলোয়ার হোসেন খান, সামসুদ্দীন আহমেদ, নুরজাহান ইয়াসমিন, খালেদা পান্নার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়। এছাড়া সংসদ সচিবালয়ের কর্মচারী কোরবান আলীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচি ও সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিনের মা শেখ রাজিয়া নাসের, প্রধানমন্ত্রীর বড় জা রওশন আরা ওয়াহেদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের স্ত্রী বুলাহ আহম্মেদ, সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের স্ত্রী গুলশান আরা, মহিলা পরিষদের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আয়শা খানম, কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, ভাষা সৈনিক জাহিদ হোসেন মুসা মিয়া, কবি মনজুরে মাওলা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ত আবদুল হান্নান খান, নাট্য ব্যক্তিত্ব আলী যাকের, সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ শাহাদাৎ হোসেন খান, বীর উত্তম ক্যাপ্টেন আকরাম, অভিনেতা আব্দুল কাদের, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়।
শোক প্রকাশ করে সংসদে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করা হয়। পরে নিহতদের স্মরণে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া।
এইউএ/এসএম