লাগাম টানতে হবে বাল্যবিয়ের

আজ জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘আমরা কন্যা শিশু, প্রযুক্তিতে হবো সমৃদ্ধ, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়বো’।
বিশ্বজুড়ে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর প্রথমবারের মতো দিবসটি পালন শুরু হয়। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো প্রতিবছরই দিবসটি পালন করে আসছে। বাংলাদেশে এবার দিবসটি পালন করা হচ্ছে ৩০ সেপ্টেম্বর। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দিনে দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে।
এবার দিবসটি উপলক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ উপলক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদফতরের সভাকক্ষে বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৩টায় আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা। মহিলা বিষয়ক অধিদফতর দেশের প্রতিটি উপজেলায় স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে দিবসটি পালনের জন্য উপ-পরিচালকদের নির্দেশ দিয়েছে বলে জানা গেছে।
ইতিহাস থেকে জানা গেছে, কন্যাশিশুদের শিক্ষা ও পুষ্টির অধিকার, আইনি সহায়তা, ন্যায় অধিকার, চিকিৎসা সুবিধা ও বৈষম্য থেকে সুরক্ষা, নারীর বিরুদ্ধে হিংসা, বলপূর্বক বাল্যবিবাহ বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে এ দিবস পালন করা শুরু হয়েছিল।
কানাডা সরকার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালনের প্রস্তাব করেছিল। পরে ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ সভায় এ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর প্রথম আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস পালন করা হয়। প্রথম আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘বাল্য বিবাহ বন্ধ করা’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে দরকার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। এ জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ হতে পারে কন্যাশিশুরা। তাদের শিক্ষার আলো দিতে হবে। কন্যাশিশুদের প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করতে পারলে ডিজিটাল বাংলাদেশের অভিযাত্রা আরও সমৃদ্ধ হবে।
বাল্যবিয়ে রোধ করার জন্য সরকার ২০১৮ সালে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। সে পরিকল্পনা অনুসারে, ২০২১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়। তবে সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সারাদেশ থেকে ৯৯৯-এ বাল্যবিয়ে হচ্ছে বা বাল্যবিয়ে ভেঙে দিতে আইনি সহায়তা চেয়ে কল এসেছে এক হাজার ৫৬১টি। ১৫৬১টি বিয়েই পুলিশ কোনো না কোনোভাবে স্থানীয় প্রশাসন, থানা পুলিশের সহায়তায় ভেঙে দিতে সক্ষম হয়।
মহিলা অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনাকালে ২০২০ সালের মার্চ-জুন পর্যন্ত দেশে ২৬৬টি বাল্যবিয়ে ঠেকানো সম্ভব হয়, তবে অন্য ২৩১টি বিয়ে ঠেকানো যায়নি।
ইউনিসেফ, ইউএনএফপি ও প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহায়তায় ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের ২১টি জেলার ৮৪টি উপজেলায় বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত জরিপ করে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’। জরিপচিত্র থেকে জানা গেছে, ওই সময়ে কম হলেও ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। ১৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হন ৫০.৬ শতাংশ, ৪৭.৭ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছর এবং ১.৭ শতাংশের বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ২০২০ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের তথ্য বলছে, দেশে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীর ৫৯ শতাংশেরই ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১২-১৩ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার জরিপ থেকে জানা গেছে, দেশে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের ৫২.৩ শতাংশই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। অর্ধযুগ পর ২০১৯ সালে সেই জরিপে বাল্যবিয়ের হার কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৫১.৪ শতাংশে।
ইউনিসেফের ২০২০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়েছে দেশে এমন নারীর সংখ্যা তিন কোটি ৮০ লাখ। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হচ্ছে বাংলাদেশে, যা বিশ্বে অষ্টম।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম ঢাকা পোস্টকে পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, করোনাকালে কাজ না থাকায় অনেকের ঘরেই অভাব দেখা দেয়। সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তাভাবনা করে অনেক বাবা-মা কন্যাশিশুকে নিজের কাছে রাখতে সাহস পাচ্ছেন না। তারা অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। তাই তড়িঘড়ি বিয়ে দিচ্ছেন।
করোনা মহামারির কারণে প্রায় দেড় বছর স্কুল বন্ধ থাকার পরে গত ১২ সেপ্টেম্বর শর্ত সাপেক্ষে স্কুল খুলে দেয় সরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর স্কুলগুলোয় বিভিন্ন শ্রেণিতে মেয়ে শিশুদের উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। ছাত্রীদের বেশিরভাগই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এ কারণে গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
সংগঠনটি মনে করে, বাল্যবিয়ে বন্ধ করা সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার কর্মসূচিগুলোর একটি। তাই মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করে গ্রাম পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ের স্কুলে করোনার পূর্বে ভর্তি ও বর্তমান উপস্থিতি বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের উপস্থিতির বিষয়টি জানার ব্যবস্থা করা। করোনাকালে কত শিক্ষার্থী ঝরে গেছে, তাদের মধ্যে কত জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে সেসব ছাত্রীদের চিহ্নিত করে স্কুলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া এবং সম্ভব হলে তাদের বিকল্প ব্যবস্থায় পড়াশোনা চালু রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
পিএসডি/জেইউ/এসএসএইচ