মণিকা ম্যাডাম বলছিলেন ‘নাজমুল আমাকে বাঁচা’

‘দুপুর ১২টার দিকে হাসপাতালের ছয়তলায় আইসিইউ ফ্লোরের ক্যাথল্যাবের বারান্দায় কাজ করছিলাম। এর মাঝেই ক্যাথল্যাবের সিনিয়র স্টাফ নার্স মণিকা প্যারেরা ম্যাডাম আমাকে এসে বলেন, নাজমুল বারান্দাটা ভালো করে পরিষ্কার কর। ম্যাডাম এ কথা বলে আবার ল্যাবের ভেতরে চলে যান।’
‘ম্যাডাম ভেতরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখি আইসিইউ ফ্লোরের তারে আগুন জ্বলছে। দ্রুত আগুন ক্যাথল্যাবে চলে আসে। এই দৃশ্য দেখে দ্রুত ক্যাথল্যাবে প্রবেশ দরজা খুলি। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের কারণে ক্যাথল্যাবের ভিতরে থাকা বিভিন্ন গ্লাস ও নানা জিনিসপত্র আমার পায়ে এবং বুকে এসে লাগে। এতে করে আমি দরজার সামনে আহত হয়ে পড়ে যাই।’
কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে আহত আইসিইউ ফ্লোরের ক্যাথল্যাবের ওয়ার্ডবয় নাজমুল হোসেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। নাজমুল হোসেন বর্তমানে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
নাজমুল হোসেন বলেন, ‘ভেতর তাকিয়ে দেখি শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। তখন ধোঁয়ার কারণে মণিকা ম্যাডামকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। পায়ে ভাঙা কাঁচের আঘাত পাওয়ায় আমিও সামনের দিকে এগোতে পাচ্ছিলাম না। তখন ভেতর থেকে মণিকা ম্যাডাম বলছিলেন, নাজমুল আমাকে বাঁচা, ভাই আমাকে বাঁচা।’
‘তখন আমি চিৎকার করে বলতে থাকি, ম্যাডাম আপনি কোথায়? কিন্তু ম্যাডামের কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না। ম্যাডামের সাড়া না পেয়ে আমি চিৎকার করে আবার বলি, আমাদের মণিকা ম্যাডাম ভেতরে আছেন, কে কোথায়, ম্যাডামকে কেউ বাঁচান। এরপর কী হয়েছে, আর কিছু বলতে পারি না। চোখে খুলে দেখি আমি হাসপাতালে। এখানে এসে শুনেছি ম্যাডাম গুরুতর আহত, আইসিইউতে রয়েছেন।’
হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়ে আইসিইউ ফ্লোরের আরেক সিনিয়র স্টাফ নার্স রুমি খাতুন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দুপুর ১২টার দিকে হাসপাতালের আইসিইউ ফ্লোরে আমরা কয়েকজন কাজ করছিলাম। আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে হঠাৎ আইসিইউতে দেখি আগুন লেগেছে। তখন বিকট শব্দে বিস্ফোরণও হয়েছিল। তবে কীসের বিস্ফোরণ, আমরা তা বুঝতে পারিনি৷’
তিনি আরও বলেন, ‘আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করি এবং যে যেদিকে পারি দৌড়াতে থাকি জীবন বাঁচাতে। এর মধ্যে আগুনের কুণ্ডলী এসে আমার বাম হাতে ও পায়ে লাগে। এতে আমার হাত ও পা পুড়ে যায়। এর মধ্যে কয়েকজন আমাকে ধরাধরি করে নিচে নামান। আমি নামার সময় আইসিইউর ফ্লোরে অনেককে পড়ে থাকতে দেখেছি।’
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, আগুনের ঘটনায় আহত নয়জনের মধ্যে পাঁচজনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ও চারজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেলে ভর্তিকৃতরা হলেন, শাহিনা আক্তার (৪০), মো. আলমঙ্গীর হেসেন (২৮), সাইদুল ইসলাম (৩৮) ও ওমর ফারুক (৩০)। শেখ হাসিনা বার্নে ভর্তিকৃতরা হলেন, রুমি খাতুন (৪০), মণিকা প্যারেরা (৪০), মো. নাজমুল হোসেন (২১), মো. জহিরুল হক মজুমদার (৪৫) ও মেরি আক্তার (২৬)। আহদের মধ্যে মণিকা প্যারেরা ছয় শতাংশ, রুমি খাতুন ৮ শতাংশ, জহিরুল হক মজুমদার ৩০ শতাংশ ও মেরি আক্তার ২০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছেন। নাজমুল হোসেন ইনহ্যালেশন ইনজুরিতে পড়েছেন। মণিকা ও জহিরুল হক মজুমদারকে আইসিইউতে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. এসএম আইয়ুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এখানে আটজনকে নিয়ে আসা হয়েছিল। এদের মধ্যে চারজনকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করা হয়েছে। বাকি পাঁচজন আমাদের এখানে চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে মণিকা প্যারেরা ও জহিরুল হক মজুমদারকে আইসিওতে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা চলছে।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় মুগদা জেনারেল হাসপাতালের ছয় তলায় আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে দুপুর ১২টা ৪৩ মিনিটে সাতটি ইউনিট পৌঁছায়। পরে ১২টা ৫৮ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার খালেদা ইয়াসমিন এ তথ্য জানান।
এমএসি/এসএএ