কন্ডাক্টর থেকে মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান!

শাহীরুল ইসলাম সিকদার; এইচএসসি পাস করে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সৌখিন পরিবহনের কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করেন। পরে সিকিউরিটি গার্ড সরবরাহের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে চাকরি দেওয়ার কথা বলে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। এরপর নামেন ফ্ল্যাট ও জমির ব্যবসায়। ফ্ল্যাট দেওয়ার নাম করে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেন।
প্রতারিত হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা নিজেদের টাকা ফেরত চাইলে শাহীরুল তাদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখান। ভুক্তভোগীদের মামলা থেকে বাঁচতে এবং নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান পরিচয় নিজেকে পরিচয় দেন। বিশিষ্টজনদের সঙ্গে ছবি বাঁধিয়ে রাখেন।
শনিবার সকালে রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী এলাকায় অভিযান চালিয়ে শাহীরুলকে গ্রেফতারের পর এসব কথা জানায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। তার কাছ থেকে তিনটি বিদেশি পিস্তল, একটি শর্টগান, একটি এয়ারগান, একটি এয়ার রাইফেল, ২৩৭ রাউন্ড গুলি, পাঁচটি ম্যাগজিন, পাঁচটি খালি খোসা, ২২টি কার্তুজ, চারটি চাকু ও তিনটি ডামি পিস্তল উদ্ধার করা হয়।
এছাড়াও জব্দ করা হয়, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিস লিমিটেডের চাকরির আবেদন ফরম, চুক্তিপত্র, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ব্যানার, প্যাড, স্ট্যাম্প, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, গোপন ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ভিজিটিং কার্ড, আইডি কার্ড, নেমপ্লেট, বিশিষ্টজনদের সঙ্গে তোলা ছবি, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, পাসপোর্ট, মানি রিসিপ্ট বই, বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম কার্ড ও মোবাইল ফোন।
শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক জানান, রাজধানীতে তার প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। এছাড়া তার কথিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিসেস লিমিটেড, হোমল্যান্ড ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ, মানবাধিকার সংস্থা, শাহীরুল অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট কো. লিমিটেড, হোমল্যান্ড হাউজিং, হোমল্যান্ড বেভারেজ অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মাদারল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড ও শাহীরুল ইসলাম বাংলাদেশ আউটসোর্সিং অ্যান্ড পাওয়ার সাপ্লাইয়ার্স অ্যাসোশিয়েশন।
তিনি বলেন, শাহীরুল ইসলামের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী আমাদের কাছে অভিযোগ দেন। তাদের অভিযোগের পর র্যাবের গোয়েন্দারা ছায়াতদন্ত শুরু করেন। পরে আমরা জানতে পারি, শাহীরুল নিজেকে কথিত মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিস লিমিটেড নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পরিচয় দেন। চাকরি দেওয়ার নামে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এ অভিযোগে রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী এলাকায় তার নিজের বাসা ও প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
যেভাবে প্রতারক হয়ে ওঠেন শাহীরুল
অল্প সময়ে বিপুল টাকার লোভে ২০১৪ সালে রামপুরায় ‘হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিস লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে শুরু করেন অর্থ আত্মসাৎ। এরপর থেকে তিনি অবৈধ সম্পদের মালিক হতে শুরু করেন। প্রতারণার অভিযোগ আড়াল করতে শাহীরুল তার অফিসের ঠিকানা পরিবর্তন করেন। নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি বেনামি মানবাধিকার সংস্থা খুলে নিজেকে চেয়ারম্যান পরিচয় দিতেন। এছাড়া ক্ষমতা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নামিদামি ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সেগুলো প্রদর্শন করেন এবং বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন।
প্রতারণা কৌশল
শাহীরুল সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দিতে চাকরির চটকদার বিজ্ঞাপন দিতেন। শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীরা বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে আবেদন করলে, কৌশলে তার পরিচালিত কোম্পানির মাধ্যমে তাদের নিয়োগ দিতে প্রতিশ্রুতি দিতেন। এরপর চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে ১৫-২৫ হাজার টাকা জামানত হিসেবে গ্রহণ করতেন। সরকারি চাকরির কথা বলে নিতেন ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা।
র্যাব জানিয়েছে, শাহীরুল নিজেকে শুটিং ক্লাবের সদস্য বলে পরিচয় দিতেন। প্রশিক্ষণ, ইউনিফরম ও অন্যান্য খরচ হিসেবেও টাকা নিতেন। এভাবে অনেকের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রতারিত হয়ে ভুক্তভোগীরা টাকা চাইলে অবৈধ অস্ত্র দেখিয়ে তাদের ভয়ভীতি দেখাতেন। কখনো কখনো প্রতারক শাহীরুল নিজেকে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিতেন। তার বিরুদ্ধে রামপুরা থানায় চাঁদাবাজি ও প্রতারণার মামলা রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, ২০০৩ সাল থেকে তিনি প্রতারণায় জড়িত। সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় দুটি বাড়ি, দুটি ফ্ল্যাট, দুটি গাড়ি ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় তার নামে ২৪ কাঠা জমির তথ্য পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৫০ কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ আমরা পেয়েছি। তবে ব্যাংক, ফিক্সড ডিপোজিট, স্বজনদের নামে কী পরিমাণ সম্পদ আছে, তা এখনো জানা যায়নি।
এমএসি/আরএইচ