রাত পোহালেই ভোট, প্রস্তুত চট্টগ্রাম

বহুল প্রতীক্ষিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হতে যাচ্ছে বুধবার (২৭ জানুয়ারি)। করোনা মহামারির কারণে নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মাস ২২ দিন পর ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে এ সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
নির্বাচনকে ঘিরে ইতোমধ্যেই সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। মঙ্গলবার (২৬ জানুয়ারি) সংবাদ সম্মেলনে সিটি নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে বিস্তারিত জানান ইসির সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর।
সংবাদ সম্মেলনে ইসি সচিব বলেন, চসিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কমিশন থেকে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। যেহেতু ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ হবে, সেহেতু ইভিএম সহায়তার জন্য কারিগরি জনবলও চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও প্রিজাইডিং অফিসারদের পাশাপাশি সব প্রস্তুতি শেষ। আশা করছি, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে সোমবার (২৫ জানুয়ারি) জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, চসিক নির্বাচন বর্তমান কমিশনের কার্যকালের অবশিষ্ট সময়ে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার শঙ্কা ও উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পরিবেশ সুষ্ঠু না হলে অবাধ নিরপেক্ষ আইনানুগ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচনের পূর্বশর্ত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ধারণাও অবান্তর হয়ে যায়। তাই সুষ্ঠু নির্বাচন দল ও মত নির্বিশেষে সবার জন্য দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষা।
চসিক নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থীর অনুসারীদের মারামারি, সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকবার। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের অনুসারীদের মধ্যেও খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে। সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে তিনজন খুন হয়েছেন।
সর্বশেষ রোববার আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউলের পক্ষে যুবলীগের প্রচারণায় অভ্যন্তরীণ বিরোধে ছুরিকাহত হয়েছেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে সোমবার মধ্যরাতে শেষ হয়েছে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা। সহিংসতা ঠেকাতে প্রায় ১০ হাজারের বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মাঠে নামানো হয়েছে।
এ ঘটনার প্রেক্ষিতেই আশঙ্কা প্রকাশ করে ইসি মাহবুব তালুকদার বলেছেন, এই নির্বাচন উপলক্ষে দুটি প্রাণহানি ঘটেছে। এজন্যই চসিকে সহিংসতার আশঙ্কা থেকে যায়। যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। এজন্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে ভোটার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচন কাজে নিয়োজিত প্রত্যেকেই নিরপেক্ষভাবে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদা সমুন্নত রাখবেন। নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের আইনানুগভাবে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। আমরা জনগণের মনে নির্বাচনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় সামিল হতে চাই।
এদিকে মঙ্গলবার ইসি সচিব বলেন, স্থানীয় প্রশাসন যেরকম চাহিদা দিয়েছে সে অনুযায়ী আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োগ দিয়েছি। এছাড়া এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে থাকবেন। দুটি ওয়ার্ডের জন্য একজন করে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। যতরকম নিরাপত্তা নেওয়ার প্রয়োজন তার সব রকম নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সিটির বাইরে থেকে যেন কোনো লোক ঢুকতে না পারে সেজন্য শহরের প্রবেশ পথে পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
চসিক নির্বাচনের মোট প্রার্থী সংখ্যা
মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মো. রেজাউল করিম চৌধুরী ও বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) আবুল মনজুর, বাংলাদেশে ইসলামী ফ্রন্টের এমএ মতিন, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. জান্নাতুল ইসলাম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী খোকন চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অন্যদিকে, ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৭২ জন কাউন্সিলর প্রার্থী ও ১৪টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৫৭ জন নারী কাউন্সিলর প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। নগরীর ৪১ ওয়ার্ডের মধ্যে অন্তত ৩৫টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, চসিক নির্বাচনে ৭৩৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৪১০টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রের পাহারায় ছয়জন অস্ত্রধারী পুলিশসহ মোট ১৮ জন দায়িত্ব পালন করবেন। আর সাধারণ কেন্দ্রে চারজন অস্ত্রধারী পুলিশসহ ১৬ জন সদস্য মোতায়েন থাকবেন। এছাড়া ভোটকেন্দ্রের বাইরে ২৫ প্লাটুন বিজিবি, র্যাবের ৪১টি টিমসহ পুলিশ ও এপিবিএন ব্যাটালিয়নের ৪১টি মোবাইল এবং ১৪টি স্ট্রাইকিং ফোর্স মাঠে থাকবেন।
ইসি সচিব জানিয়েছেন, সিটি নির্বাচনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ২০ জন জুডিশিয়াল ও ৪০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োগ করা হয়েছে। তারা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবেন।
মোট ভোটার সংখ্যা
চসিকে মোট ভোটার ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৩ জন ও নারী ভোটার ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৩ জন। এ নির্বাচনে ৪১টি ওয়ার্ডে ৭৩৫টি ভোটকেন্দ্র ও চার হাজার ৮৮৬টি বুথ রয়েছে।
নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্মকর্তা
চসিক নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ৭৩৫ জন প্রিসাইডিং অফিসার, চার হাজার ৮৮৬ জন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও ৯ হাজার ৭৭২ জন পোলিং অফিসার। এছাড়াও অতিরিক্ত পাঁচ শতাংশ হিসেবে মোট ১৬ হাজার ১৬৩ জন ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী একই বছরের ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটিতে ভোটগ্রহণ হওয়ারও কথা ছিল। করোনাভাইরাসের কারণে নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে গত ২১ মার্চ প্রথম দফায় চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন স্থগিত করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ১৪ জুলাই পুনরায় চসিক নির্বাচন স্থগিত করা হয়। এ সময় চসিকের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজনকে। প্রশাসকের মেয়াদের শেষ পর্যায়ে ২৭ জানুয়ারি ভোটের নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল চসিক নির্বাচনের ভোটগ্রহণ করেছিল ইসি। এ সিটির মেয়াদ শেষ হয়েছিল ২০২০ সালের ৫ আগস্ট।
এসআর/ওএফ