রাজনৈতিক দলগুলোকে পরমতসহিষ্ণু হওয়ার আহ্বান রাষ্ট্রপতির
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সোনার বাংলা’ গড়তে রাজনৈতিক দলগুলোকে পরমতসহিষ্ণু হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
বুধবার (২৪ নভেম্বর) একাদশ জাতীয় সংসদের পঞ্চদশ অধিবেশনে স্বাধীন বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে জাতীয় সংসদের বিশেষ আলোচনার স্মারক বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।
আবদুল হামিদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রয়োজন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবার মধ্যে ঐক্য। ঐক্য গড়ে তুলতে হবে সাম্প্রদায়িকতা, অগণতান্ত্রিকতা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক দলগুলোকে পরমতসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, আসুন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে জাতির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ও দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার মধ্য দিয়ে লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করতে দলমতের পার্থক্য ভুলে উন্নয়নের যাত্রায় সামিল হওয়ার আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি।
তিনি বলেন, জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৭৫ এর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং উপযুক্ত নীতি ও কার্যক্রমের অভাবে অর্থনীতিতে তেমন গতি সঞ্চার হয়নি। তবে বিগত একযুগেরও বেশি সময় ধরে জাতির পিতার আদর্শের সরকার দায়িত্বে থাকায় তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ফলে দেশ আজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।
গণপরিষদ এবং দেশের প্রথম জাতীয় সংসদের সদস্য তার বক্তৃতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও উন্নয়নের ধারাবাহিক চিত্র তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীতে ‘গুরুত্বপূর্ণ অর্জন’। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্টের নির্ধারিত তিনটি সূচক মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকের প্রতিটিতে নির্ধারিত স্কোরের বেশি অর্জন করায় ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করে, যা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ক্ষণে দেশের এ সাফল্য জাতির জন্য বয়ে এনেছে এক অভাবনীয় গৌরব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ, দূরদর্শী ও অদম্য নেতৃত্বের জন্য আমাদের এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। এজন্য আমি তাকে আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই।
রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশন সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারসহ চাঞ্চল্যকর অন্যান্য মামলার রায় দ্রুত নিষ্পত্তি করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দুর্নীতি, মাদক, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কারণে দেশে স্বস্তি বিরাজ করছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। সুশাসনের উদ্দেশ্যে প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার লক্ষ্যে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি, অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা, সিটিজেনস চার্টার এবং শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সুশীল সমাজ এবং অংশীজনদের সমন্বিতভাবে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দেন রাষ্ট্রপতি।
মো. আবদুল হামিদ বলেন, সরকারের সময়োচিত ও দূরদর্শী পদক্ষেপের কারণে অনেক উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ এবং সংক্রমণজনিত মৃত্যুর হার অপেক্ষাকৃত কম। কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাকে সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত করলেও থামিয়ে দিতে পারেনি। ইতোমধ্যে ৪ কোটি ৫৫ লাখ ৯১ হাজার ৫৭৮ জনকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে। সরকার ২৮টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়ন কর্মসৃজন ও কর্মসুরক্ষা, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সরকারের নানামুখী জনকল্যাণকর কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের একটি মানুষও না খেয়ে থাকেনি। জীবন-জীবিকার অসাধারণ সমন্বয়ের মাধ্যমে করোনা সংকট মোকাবিলায় অনন্যসাধারণ নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে বিশ্ব নেতারা এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এ স্বীকৃতি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের, যা বিশ্ব দরবারে আমাদের সম্মান আরও বৃদ্ধি করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতি হিসেবে আমরা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত অতিক্রম করছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর সোপান বেয়ে আমরা পৌঁছে গেছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর স্বর্ণতোরণে। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণ এখন সমাপ্তির পথে। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় মনোবল, বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন হয়েছে। এ সেতুর বাস্তবায়ন জাতি হিসেবে আমাদের স্বকীয়তা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা, সক্ষমতা, জবাবদিহি, দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতীকস্বরূপ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস দিয়েছে।
তিনি বলেন, এমডিজির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এসডিজির বিভিন্ন সূচকে অনন্য অগ্রগতির স্বীকৃতিস্বরূপ সম্প্রতি বাংলাদেশ ‘এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত হয়। এ প্রাপ্তি আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের এক বিশাল অর্জন। এ সম্মান বাংলাদেশের, এ সম্মান সমগ্র বাঙালি জাতির।
আবদুল হামিদ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ‘রূপকল্প ২০২১’-এর সার্থক বাস্তবায়ন শেষে ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়ন করছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রয়োজন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা। পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ ব্যাপক শিল্পায়ন, অর্থনীতি সুসংহতকরণ, সুষ্ঠু অবকাঠামো এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাসহ মেধাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে নিরলসভাবে কাজ করে যেতে হবে।
বিকেল তিনটায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়। এরপর সংসদ কক্ষে ঢোকেন রাষ্ট্রপতি। তার প্রবেশের সময় বিউগলে বাজানো হয় ‘ফ্যানফেয়ার’। রাষ্ট্রপতি সংসদ কক্ষে পৌঁছালে নিয়ম অনুযায়ী যন্ত্রের সাহায্যে জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। তিনি স্পিকারের পাশে রাখা ডায়াসে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেন।
রাষ্ট্রপতির ২৫ মিনিটের বক্তব্য শেষে নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। সংসদ কক্ষ থেকে তিনি চলে যাওয়ার পর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশন ২০ মিনিটের জন্য মুলতবি করেন।
এইউএ/এসএম/জেএস