মদপানের অনুমতি ছিল না ব্যাম্বোশ্যুটসের

রাজধানীর ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) শিক্ষার্থীর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় ভিকটিম তরুণী ও তার বন্ধুরা উত্তরায় ব্যাম্বোশ্যুটস নামে যে রেস্টুরেন্টে মদপান করেছিলেন, সে রেস্টুরেন্টটির মদ বিক্রি বা পান করার কোনো অনুমতি ছিল না বলে জানিয়েছে পুলিশ। সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) উত্তরা পশ্চিম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তপন চন্দ্র সাহা ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে ব্যাম্বোশ্যুটস রেস্টুরেন্টটি অবস্থিত। তারা সাধারণ খাবার বিক্রি করত। সেখানে মদপান বা বিক্রি করার কোনো অনুমতি নেই। ভিকটিমসহ পাঁচজন যখন ওই রেস্টুরেন্টে অবৈধভাবে মদ খাচ্ছিল তখন কর্তৃপক্ষ পুলিশকে কিছু জানায়নি। তাই নিয়ম ভাঙার কারণে রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশ ইতোমধ্যেই ব্যাম্বোশ্যুটসে গিয়ে তদন্ত করে এসেছে।
এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আব্দুল লতিফ বলেন, ওই রেস্টুরেন্টে ভিকটিমসহ পাঁচজন মদপান করে। একপর্যায়ে ভিকটিম ও তার বন্ধু নেহা বমি করে। রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে পুলিশকে কিছু জানায়নি। এ ঘটনায় তারাও জড়িত থাকতে পারে। আমরা উত্তরা পশ্চিম থানার সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এদিকে, এখন পর্যন্ত ওই ছাত্রীর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এছাড়াও দেহের সংবেদনশীল অংশগুলোতেও জোরপূর্বক সঙ্গমের আলামত পাওয়া যায়নি।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আ ম সেলিম রেজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোববার রাতে মেয়েটির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে কি-না, তা জানতে ভিসেরা আলামত নেয়া হয়েছে। এছাড়াও তার যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথ থেকে আলামত সংগ্রহ করে ডিএনএ টেস্টের জন্য পাঠানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মরদেহে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এছাড়াও দেহের সংবেদনশীল অংশগুলোতেও জোরপূর্বক সঙ্গমের আলামত পাওয়া যায়নি।
তবে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ সম্পর্কে এখনই কিছু বলতে পারছেন না তিনি। সেলিম রেজা বলছেন, ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
সোমবার আলোচিত এ ঘটনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশিদ।
ডিসি হারুন বলেন, আমরা শুনেছি নেহার বন্ধু বিমানবন্দর থেকে মদ এনে উত্তরার ব্যাম্বোশ্যুট রেস্টুরেন্টে খেয়েছে। আমরা সে ছেলের নাম-পরিচয় এখনও পাইনি। তাকে খোঁজা হচ্ছে। সে মদপানের কারণেই কিছু হয়েছে কি-না বা মদে বিষক্রিয়া হয়েছে কি-না তা আমরা তদন্ত করছি। এছাড়াও উত্তরার যে রেস্টুরেন্ট এ মদ পান করা হয়েছিলো, তাদের লাইসেন্স আছে কি-না তাও তদন্ত করা হচ্ছে।
তরুণীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নিহত তরুণীর ভিসেরা নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি গ্রেপ্তার দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ দুই মিলে তদন্তে প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে হয়েছে যে অতিরিক্ত মদপান, মদে বিষক্রিয়া অথবা বেশি মদ পান করিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে পারে।
ডিসি বলেন, এ ঘটনায় আরাফাত নামের অন্যতম এক আসামি হাসপাতালে মারা গেছে। এছাড়াও নেহা নামের আরেক বান্ধবী অসুস্থ হয়েছে। চিকিৎসা শেষে সে বাসায় ফিরেছে। রায়হান ও নিহত তরুণী সেদিন রাতে তাফসিরের বাসায় যায়। তাদের মধ্যে একটা পূর্ব-সম্পর্ক ছিল। তাফসিরের বাসায় তাদের মধ্যে অবৈধ মেলামেশা হয়। এরপরই মেয়েটা বমি শুরু করে। এরপর তাকে ইবনে সিনায় ভর্তি করা হয়, সেখান থেকে আনোয়ার খান মেডিকেলে নেওয়া হলে মেয়েটি রোববার মারা যায়।
এর আগে রোববার রাজধানীর আনোয়ার খান মেডিকেলে আরাফাত নামে ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। কারণ হিসেবে ডিসি বলেন, অতিরিক্ত মদপান, সঙ্গে বিষক্রিয়া হতে পারে বলে আমাদের ধারণা।
এ ঘটনায় একটি মামলা করেছে নিহত তরুণীর বাবা। মামলার এজাহারে ওই তরুণীকে মদ পান করিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার কথা বলা হয়েছে। এতে সহযোগী হিসেবে ৫ জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রোববারই মোহাম্মদপুর থানায় মামলাটি এন্ট্রি করা হয়। প্রধান আসামি মর্তুজা রায়হান চৌধুরী, তাকে ধর্ষণকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য ৩ জন হচ্ছেন নুহাত আলম তাফসির (২১), আরাফাত (২৮), নেহা (২৫)। আরেক বন্ধুর নাম জানা যায়নি। মামলায় অজ্ঞাত হিসেবে তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে, ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ২৮ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় মর্তুজা রায়হান ওই তরুণীকে নিয়ে মিরপুর থেকে আসামি আরাফাতের বাসায় যান। সেখানে স্কুটার রেখে আরাফাত, ওই তরুণী ও রায়হান একসঙ্গে উবারে করে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ব্যাম্বোশ্যুট রেস্টুরেন্টে যান। সেখানে আগে থেকেই আরেক আসামি নেহা এবং একজন সহপাঠী (তরুণ) উপস্থিত ছিলেন। সেখানে আসামিরা ওই তরুণীকে জোর করে ‘অধিক মাত্রায়’ মদপান করান।
এজাহারে আরও বলা হয়েছে, মদ্যপানের এক পর্যায়ে ভুক্তভোগী তরুণী অসুস্থ বোধ করলে রায়হান মোহাম্মদপুরে তার এক বান্ধবীর বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে নুহাতের বাসায় নিয়ে যান। সেখানে তরুণীকে ধর্ষণ করেন রায়হান। এ সময় রায়হানের বন্ধুরাও রুমে ছিল। তাদের চোখের সামনেই ধর্ষণ করা হয়।
ধর্ষণের পর রাতে ওই তরুণী অসুস্থ হয়ে বমি করলে রায়হান তার আরেক বন্ধু অসিম খান কোকোকে ফোন দেন। সে বন্ধু পরদিন এসে ওই তরুণীকে প্রথমে ইবনে সিনা ও পরে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি করেন। দুইদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর রোববার তরুণী মারা যান। এজাহারে ধর্ষক হিসেবে মর্তুজা রায়হান চৌধুরীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদের ভূমিকা ‘জোর করে মদপান করিয়ে ধর্ষণের সহযোগিতা’ উল্লেখ করা হয়েছে।
ঘটনার বিষয়ে পুলিশ বলছে, তরুণীর মৃত্যুর কারণ এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে বিস্তারিত বলা যাবে। ময়নাতদন্তের জন্য নিহতের মরদেহ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা আছে।
এর আগে গত ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানে একই ধরনের একটি ঘটনায় আনুশকা নূর আমিন নামের মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। সেদিন বান্ধবীর বাসায় জন্মদিন পালন করতে যান আনুশকা। সেখানেই শারীরিক নির্যাতনের পর তাকে হত্যা করা হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। ওই ঘটনায় কলাবাগান থানায় মামলা করেন আনুশকার বাবা। আসামি ইফতেখার ফারদিন দিহান বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
এমএসি/এআর/এমএইচএস