নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি গঠন অত্যন্ত জরুরি
গত এক দশকে নারীদের অগ্রযাত্রা চোখে পড়ার মতো। গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী, নারী ও পুরুষে সমতা আনয়নে বাংলাদেশ একটানা সাতবার দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা দেশ হিসেবে ভূষিত হয়েছে। এর প্রমাণ আমাদের সামনেই রয়েছে- বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে নারীরা বিগত ৫০ বছরে পুরুষদের তুলনায় বেশি সময় (২৭ বছর) ধরে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেছে।
আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, আমাদের স্পিকার একজন নারী এবং সরকারি প্রচুর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আছেন যারা নারী। শুধু তাই নয়, মাঠপর্যায়ে অনেক নারী সরকারি কর্মকর্তা সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। বেসরকারি খাতেও নারী নেতৃত্ব চোখে পড়ার মতো। এই সকল সম্ভাবনার কথা ভালোলাগার সাথে সাথে আশার আলো দেখায়। কিন্তু এখানেই কি শেষ? আমরা কি এখানেই থেমে থাকব?
নারীদের চলার পথে প্রচুর বাধা-বিপত্তি রয়েছে। শহরে হোক অথবা গ্রামে—বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের সবচেয়ে বড় সমস্যা এখনো নারীবিরোধী নেতিবাচক সমাজ মনস্তত্ত্ব। আমাদের সমাজে এখনো অসংখ্য মানুষের ধারণা নারীর কাজ শুধুমাত্র ঘর-সংসার দেখে রাখা, স্বামী-শ্বশুরের দেখাশোনা করা। এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে গ্রামীণ মেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর আগেই অনেক সময় শিক্ষায় ইতি টানতে হয় এবং সঠিক বয়সের পূর্বেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়।
সম্প্রতি বাল্যবিবাহ বন্ধে আইন প্রণীত হয়েছে। তবুও আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নানা কারসাজি করে এখনো বাল্যবিবাহ হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি। যদিও ইউএনএফপির এপ্রিল ২০১৯-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়- বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ কমে এখন দাঁড়িয়েছে ৫৯ শতাংশে। এই উন্নতির ধারাকে অব্যাহত রাখা এখন কেবল সময়ের দাবি।
এছাড়াও শহরে ও গ্রামে যৌন হয়রানি এবং সামাজিক নিপীড়নের উদাহরণের শেষ নেই—যা শুধুমাত্র সামাজিক মূল্যবোধের অভাব ও বর্তমান সমাজব্যবস্থার অপব্যবহারের কারণেই হচ্ছে। এখন আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত না করা গেলে এসকল প্রতিবন্ধকতা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই।
নগরে নারীর একা চলাচলে রয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব। যানবাহনে চলাচলে নিরাপত্তাহীনতা, প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানি ও আইনের সঠিক প্রয়োগের অনিশ্চয়তা নারীর স্বাধীন চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করছে প্রতিনিয়ত।
ব্র্যাকের জরিপ অনুযায়ী, ৯৪ শতাংশ নারী রাস্তায় হয়রানির শিকার হন। এসকল হয়রানি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কর্মক্ষেত্রসহ সকল ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
কর্মজীবী নারীদের জন্য বাস সার্ভিস নিশ্চিত করতে হবে এবং এসব অপ্রত্যাশিত ঘটনাকে ঘিরে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া মাননীয় হাইকোর্ট ২০১১ সালে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন যার জন্য সর্বস্তরে সচেতনতা প্রয়োজন।
নারী ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হলো নারী শিক্ষা। নারীদের যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে তারা নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হবে না, সামাজিক ভারসাম্যও তৈরি হবে না।
একটি প্রবাদ রয়েছে, একজন পুরুষকে শিক্ষা দেওয়া মানে একজন ব্যক্তিকে শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলা। আর একজন মেয়েকে শিক্ষা দেওয়া মানে গোটা পরিবারকে শিক্ষিত করে তোলা। তাই সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায় নারী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
সরকারের শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী শিক্ষার্থীর হার প্রায় ৫১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকেও প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ছাত্রী। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেয়েদের হার কিছুটা কম (৩৮ শতাংশ)। এই শিক্ষার হার আরও বাড়াতে পারলে আমরা উন্নত জাতি গঠনে আরও এক পা সামনে এগিয়ে যেতে পারবো বলে আমি মনে করি।
বিদ্যমান আইনের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই যে, প্রচলিত আইন ও বিচার ব্যবস্থায় নারী অধিকার সুরক্ষা সহজসাধ্য নয়। আমাদের সমাজে নারীর প্রতি অপরাধ ঘটলে নারীকেই দায়ী করা হয়। সমাজ প্রশ্ন তোলে নারীর চালচলন, পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে। নারী কেন সাবধান হলো না, নারী কেন ওই স্থানে গেল—এসব হীনমন্য উক্তি নারীকেই শুনতে হয়।
ঘৃণিত অপরাধের শিকার নিরপরাধ নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে এবং অপরাধের শিকার নারীকে রাষ্ট্র ও সমাজ প্রাপ্য মর্যাদা বা সম্মান না দিলে, কেবলমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার মিথ্যা আশ্বাস এবং নারী উন্নয়ন গাঁথার রাজনৈতিক প্রচার দ্বারা কখনোই অপরাধের শিকার অসহায় নিরপরাধ নারীর প্রতি সুবিচার করা সম্ভব নয়।
একটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তার পরিবার থেকে, প্রকারান্তরে তার মা থেকে। বাংলাদেশে সাধারণত ছোটবেলা থেকেই বেশিরভাগ শিশু এই দেখে বড় হয় যে, তার মা তাকে লালনপালন ও গৃহস্থালি কাজে দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করছে।
ছোটবেলা থেকেই তাই বেশিরভাগ মানুষের একটা মনস্তাত্ত্বিক গড়ন এমন হয়ে ওঠে যেন মেয়ে মানেই সে শুধুমাত্র বাসায় কাজ করবে, সে বাসার অন্যদের চেয়ে কিছুটা আলাদা, বাসায় সে শুধু একজন নারীই। এরকম প্রচুর পরোক্ষ শিক্ষা আমাদের বর্তমান সামাজিক অসঙ্গতির অন্যতম কারণ। এছাড়া শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে নারী-পুরুষের অধিকার নিয়ে তেমন একটা সংযোজন না থাকায় এসব সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।
নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি গঠন অত্যন্ত জরুরি। নারীর ক্ষমতায়নের চর্চা শুরু হয় ঘর থেকেই। শৈশব থেকেই প্রতিটি মানুষের নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানসিকতা গঠন অত্যন্ত জরুরি।
আমাদের সংবিধানে শুধু নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে ২৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবে। তাই করুণা নয়, যোগ্যতাবলেই নারীকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের ধারা তৈরি করতে হবে। আশার কথা হচ্ছে—নারীর সমান অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের নতুন প্রজন্ম এখন বেশ সচেতন।
বাংলাদেশের জিডিপি বাড়ছে, আমাদের শ্রমশক্তির প্রায় ৩৫ শতাংশ জুড়ে আছে আমাদের মেয়েরা, তারা দেশে ও দেশের বাইরে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে।
আমাদের উন্নয়নের এই গতি ত্বরান্বিত করতে নতুন প্রজন্মের নারী-পুরুষ পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে একসাথে কাজ করবে এবং আমাদের দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
মুবিনা আসাফ ।। হেড অফ লিগ্যাল অ্যান্ড এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স, বিএটি বাংলাদেশ