স্বাধীনতা-পরবর্তী গণ আন্দোলন

Dr. Sarwar Ali

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৫:২৫ এএম


স্বাধীনতা-পরবর্তী গণ আন্দোলন

যখন দাবী আদায়ের জন্য কোন জনগোষ্ঠীর কার্যক্রম নেতা ও কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তখন সেটি আন্দোলন বটে, তবে তাকে গণ আন্দোলন রূপে গণ্য করা যায় না। দাবী আদায়ের যাত্রাপথ এ-রূপে সূচিত হলেও, যখন আন্দোলনে নানা ক্ষেত্রের সর্বজনের কিংবা ব্যাপক মানুষের যুক্ততা কর্মসূচিতে দৃশ্যমান হয়, তখন তাকে গণ আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। স্বাধীনতা পূর্বকালে গণ আন্দোলন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মার্চে অসহযোগ আন্দোলন। অবরুদ্ধ দেশে সর্বজনের প্রত্যক্ষ সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জনযুদ্ধের রূপটি আমরা লক্ষ্য করেছি।

পরাধীন দেশ থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভবের পর স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের গণ আন্দোলন প্রত্যাশিত নয়, তবে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়। সামরিক সেনাশাসন প্রায় দেড় দশক অব্যাহত ছিল। সে সময়কালে গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ভাবে বিচ্যুতি ঘটে। সে বিবেচনায় ১৯৯২ সালে সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ২০১১ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে দল ও দল নিরপেক্ষ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায় এবং এটি গণ আন্দোলন রূপ পরিগ্রহ করে। ১৯৯২ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবীতে সংগঠিত গণজাগরণ মঞ্চের আবির্ভাব বস্তুত পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কর্তব্য সাধনের প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছিল।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়। সামরিক সেনাশাসন প্রায় দেড় দশক অব্যাহত ছিল। সে সময়কালে গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ভাবে বিচ্যুতি ঘটে।

আশির দশকের প্রারম্ভে গণতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্র ও রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম শুরু হয়। তবে বারবার এটি হোঁচট খেয়েছে। পরে পেশাজীবীরা এর সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যায়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার যুক্ত ঘোষণা এবং ত্রিদলীয় জোটের আবির্ভাব এই আন্দোলনে গতিবেগ সঞ্চার করে এবং ডা. মিলনের মৃত্যুর পর চূড়ান্তরূপ অর্জন করে। পরিশেষে, গণ আন্দোলনের মুখে শীর্ষ সেনাকর্মকর্তারা জেনারেল এরশাদকে পরিত্যাগ করে। পরবর্তীতে আইনানুগ পদ্ধতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য উল্লেখ্য যে, গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরও দলীয় সরকারের নানা অনাচারের ফলে মানুষ প্রায়শ ক্ষুব্ধ হতে শুরু করে এবং সামরিক অভ্যুত্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং সর্বসাধারণ কয়েক বছরের মধ্যে পুনরায় গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষায় ফিরে আসে।

গণজাগরণ মঞ্চের ঘটনাটি কিছুটা ভিন্নধর্মী। মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কর্তব্য ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার কাজ সম্পন্ন করা। গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদানের পর মূলত: বুদ্ধিজীবীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। পরে এর সাথে আওয়ামী লীগ যুক্ত হয়ে গণআদালত গড়ে তোলে। ২০০৯ সালের নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধের বিচার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদা ছিল এবং ক্ষমতা গ্রহণের পর এই বিচারকার্য শুরু হয়। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ছাত্র ও যুবকেরা এই আন্দোলনের সূচনা করে এবং দ্রুত সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সমর্থন জোগায় ও সর্ব সাধারণের যুক্ততা লক্ষ্য করা যায়। ফলশ্রুতিতে, জাতীয় সংসদের অধিবেশনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনটি সংশোধিত হয়।

যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ের বিষয়ে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চুপ থেকেছে। ২০১০-এর পর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন এবং দমন-পীড়নের অভিযোগ নিয়ে বিএনপি ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ ও পালন করেছে। কিন্তু এই আন্দোলন অদ্যাবধি নেতা ও কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে, যে জনসমর্থন তাদের রয়েছে, তার প্রতিফলন আন্দোলনে দেখা যায় না।

সুতরাং উভয় গণ আন্দোলন সফলতার মুখ দেখেছে। তবে নানা কারণে গণজাগরণ মঞ্চের পরিণতিটি সুখকর ছিল না। অবশ্য যুদ্ধাপরাধের বিচার কাজটি অগ্রসর হয়েছে। অবশ্য যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামের নেতৃত্বে আন্দোলন দেখা গেছে। তবে তাদের আন্দোলনের রূপ ছিল ভিন্নতর। জ্বালাও-পোড়াও-যুক্ত এই আন্দোলন গণ আন্দোলন রূপ নেয়নি, বরং সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। এ ধরনের নাশকতামূলক কর্মসূচি সন্ত্রাসী কার্যক্রমের নামান্তর। যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ের বিষয়ে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চুপ থেকেছে। ২০১০-এর পর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন এবং দমন-পীড়নের অভিযোগ নিয়ে বিএনপি ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ ও পালন করেছে। কিন্তু এই আন্দোলন অদ্যাবধি নেতা ও কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে, যে জনসমর্থন তাদের রয়েছে, তার প্রতিফলন আন্দোলনে দেখা যায় না।

গত কয়েক দশকে সুশীল সমাজের কার্যক্রম বিশেষভাবে লক্ষ্য করা গেছে; সেটি সেমিনার ও মানববন্ধনে প্রকাশ পায়। তবে তাদের অধিকাংশ কর্মসূচি সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেনি। পেশাজীবীদের কিছু আন্দোলন হয়েছে, তাদের আন্দোলনের সাময়িক সাফল্য আনলেও পরবর্তীতে এই সাফল্য রক্ষিত হয়নি। বরং পেশাজীবী সংগঠনের দলীয়করণ সুস্পষ্ট হয়েছে।

গত অর্ধ শতবর্ষে পৃথিবী ও বাংলাদেশ বদলে গেছে। আশির দশকের শেষপ্রান্ত থেকে একক পরাশক্তির বিশ্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। টুইন টাওয়ার ট্র্যাজেডির পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মোকাবিলায় জঙ্গিবাদের জন্ম হয়েছে। তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়েছে কিন্তু বিবেকবান মানুষ নিরপরাধ মানুষ হত্যার পক্ষপাতি নয়। সর্বোপরি, তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতি ও বিস্তার ঘটেছে এবং এর ফলে তরুণ সমাজের জীবনযাত্রা ও চিন্তাধারার রূপান্তর ঘটেছে।

বাংলাদেশের জনমনে এই সকল ঘটনাবলীর প্রভাব লক্ষণীয়। বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। তার চালিকাশক্তি যুব সমাজ। দেশজুড়ে বিপুল কর্মযজ্ঞ চলছে; জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে তারা ব্যতিব্যস্ত। তাদের ব্যাপকতর অংশ দলীয় রাজনীতি ও তার সংঘাত নিয়ে ভাবিত নয়। এর ফলে তারা রাষ্ট্রের কোনো সিদ্ধান্তে বিক্ষুব্ধ হলেও গণ আন্দোলন চিরায়ত পদ্ধতি তাদের কাছে অকেজো হয়ে পড়েছে। বর্তমান সময়ে সামাজিক মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং দাবী আদায়ের কোনো কর্মসূচি জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে এটি মূল মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। জীবন ও জীবিকার লড়াইয়ে কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ ধর্মঘট ও হরতালে একান্ত অপারগ না হলে অংশগ্রহণ করে না। সুতরাং ভবিষ্যতে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনার অপেক্ষা রাখে।

ডা. সারওয়ার আলী ।। ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর; নির্বাহী সম্পাদক, ছায়ানট

Link copied