বিদ্যুৎ সংকট : সমাধান হবে কবে?

Dr. Farseem Mannan Mohammedy

২৯ অক্টোবর ২০২২, ০৯:৫৪ এএম


বিদ্যুৎ সংকট : সমাধান হবে কবে?

ছবি : সংগৃহীত

শতভাগ বিদ্যুতায়ন থেকে বিপর্যয়
শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ সেবা পেয়েছে। ফলে গ্রিডে যথেষ্ট বিদ্যুৎ থাকলে গ্রাহক পাবেন। এর অর্থ এই নয় যে ২৪/৭ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রবাহ থাকবে। বিদ্যুৎ বিপর্যয় হতেই পারে, শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের মতো বড় দেশেও হয়েছে, উত্তর আমেরিকাতেও হয়েছে।

বিপর্যয় হয়, নানান কারিগরি, পদ্ধতিগত ব্যবস্থা কিংবা মানবীয় ভুলের কারণে। এর সাথে বিদ্যুতায়নকে মিলিয়ে দেখা যাবে না। তবে, শতভাগ বিদ্যুৎ সংযোগ আছে, অথচ বিদ্যুৎ পাচ্ছে না—এমন হলে সেটা নীতিনির্ধারক এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপকদের নজর দিয়ে দেখতে হবে। শুধু তার আর মিটার থাকলেই আনন্দের হয় না, প্রকৃত আনন্দ তখনই যখন মিটারে বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে।

ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র কেন এখনো রাখা হয়েছে সেটা মন্ত্রণালয় জবাব দিতে পারবেন। তবে তাদের ক্যাপাসিটিকে যদি ব্যবহার করার দরকার হয় কিংবা ব্যবহার করা যায়, তবে যৌক্তিকতা দেখাতে হবে, কেননা এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ তাতে খরচ হচ্ছে।

আরও পড়ুন : লোডশেডিং : এত বিপর্যয় কেন? 

আগে প্রয়োজন ছিল, তখন করা হয়েছিল। কিন্তু এখন সত্যিই প্রয়োজন আছে কি না, ভেবে দেখতে হবে। এসব ক্ষেত্রে যেটা প্রয়োজন তা হলো নিজস্ব পরিকল্পনাবিদ তৈরি এবং এনার্জি মডেলিং ও ফোরকাস্টিংয়ের সক্ষমতা।

দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমরা সরকারি মনোযোগ দেখি না। বিদেশি নির্ভর হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ খাত; কী জ্বালানি সরবরাহে, কী বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্ল্যানিংয়ে। এসব আমাদের নিজস্ব চিন্তায় আনতে হবে।

গ্রিডে যথেষ্ট বিদ্যুৎ থাকলে গ্রাহক পাবেন। এর অর্থ এই নয় যে ২৪/৭ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রবাহ থাকবে। বিদ্যুৎ বিপর্যয় হতেই পারে, শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের মতো বড় দেশেও হয়েছে, উত্তর আমেরিকাতেও হয়েছে।

ক্যাপাসিটির জন্য যাদের রাখা হয়েছে তাদের যেমন অতিরিক্ত চার্জ দিতে হয়, আবার প্রয়োজনে বিদ্যুৎ দিতে না পারলেও তাদের জরিমানা হয় এবং তাদের ক্যাপাসিটি ধরে রাখার জন্য তাদের নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যন্ত্রপাতি, ইত্যাদি সার্বক্ষণিক তৈরি রাখতে হয়, এতেও খরচ আছে—এই সত্যও মাথায় রাখতে হবে।

ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র
ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কাজ করছে না—এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। এটি একটি অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর সুফল নেই—এমন কথা দায়িত্বহীন কথা।

আরও পড়ুন : লোডশেডিং : সাশ্রয়েই সমাধান? 

বিদ্যুতকেন্দ্রের সফলতা মাপা যেতে পারে তার প্ল্যান্ট এভেইলেবিলিটি দিয়ে, সক্ষমতা দিয়ে। ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এর সবকটিতেই উতরে যাবে অধিকাংশ মাপকাঠিতে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে
এই মুহূর্তে উত্তরণের পথ একটাই—ধৈর্য ধারণ। এই অবস্থা শেষ হবে, কিন্তু সহসাই নয়। শীতের মৌসুমে এই কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে, কিন্তু পুরোপুরি যাবে না, কেননা অনেক প্ল্যান্টের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের এটাই সময়। এর কারণ, সবাই জানি, আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে মূল্যের ওঠানামা।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশ এই সমস্যায় পড়েছে। আইইএ (International Energy Agency : IEA) বলছে, এটা "ট্রু'লি গ্লোবাল ক্রাইসিস"। অতএব, এটা বৈশ্বিক জ্বালানি সমস্যা এখন, ফলে এটা থেকে পরিত্রাণের সুযোগ নাই।

পৃথিবীর ৯৫ শতাংশ দেশ জ্বালানি আমদানি করে, ফলে এই সমস্যা তাদেরও হচ্ছে, আমাদেরও হচ্ছে। একটা পথ সবাই বলছেন সেটা হলো, নিজস্ব গ্যাস উত্তোলন এবং আমদানি নির্ভর এলএনজি'র উপর অতি-নির্ভরতা।

এই মুহূর্তে উত্তরণের পথ একটাই—ধৈর্য ধারণ। এই অবস্থা শেষ হবে, কিন্তু সহসাই নয়। শীতের মৌসুমে এই কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে, কিন্তু পুরোপুরি যাবে না

তবে, এমন হলেও যে বৈশ্বিক জ্বালানি-সংকট থেকে আমরা সম্পূর্ণ স্বনির্ভর থাকতাম, এমনটি বলা যাবে না। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন আমদানি নির্ভর সব খাতেই অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।

লোডশেডিং বাড়ছে
এটা একটা বড় সমস্যা। কেননা শিল্প-কারখানা গ্যাস নির্ভর, সেই গ্যাস যদি র‍্যাশনিং করে বিদ্যুৎ খাতে নিয়ে আসা হয়, তবে কারখানা চলবে কীভাবে? কারখানা না চললে রপ্তানি হবে কীভাবে? এবং এমতাবস্থায় শ্রমিক চাকরি হারালে বা বেতন না পেলে রাস্তায় নেমে ক্ষোভ প্রকাশ করবে। এটা খুবই ডেলিকেট ইস্যু—সরকারের জন্য।

আরও পড়ুন : মেগা প্রকল্প, উচ্ছেদ ও কর্মসংস্থানের ভ্রান্ত প্রতিশ্রুতি

বাসাবাড়িতে প্রয়োজনে আরও লোডশেডিং করে কারখানায় এনার্জি সাপ্লাইয়ের কথা সরকারের কোনো কোনো মহল ভেবেছেন। আবার ভোলা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস আনার কথাও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এগুলো কোনোটাই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়—এমনকি ছয়মাস পর কী হবে সেটাই কেউ জানেন না। সরকার অবশ্য আন্তর্জাতিক নানা ক্ষেত্র থেকে জ্বালানি সরবরাহ চাইছেন—যেমন ব্রুনাই। এখন দেখা যাক সামনে কী হয়।

বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান
এর কোনো দ্রুত সমাধান আমাদের কাছে নেই। আগে যা যা বলা হয়েছে তার প্রেক্ষিতে এই মুহূর্তে ধৈর্য ধারণ ছাড়া গত্যন্তর নেই। আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা (মূলত ইউরোপ এবং কিছুটা চীনের প্রভাব, কেননা এরা গ্যাস ও তেল মজুদ করতে গিয়ে দাম বাড়িয়েছে, ওপেক-প্লাস এবং মধ্যপ্রাচ্যও তাদের সুবিধা অনুযায়ী কাজ করছে) না কাটলে এই অবস্থায় বাস্তব-বুদ্ধি সহযোগে চলতে হবে। আর এখান থেকে শিক্ষাও নিতে হবে বিকল্প জ্বালানি বিষয়ে বিনিয়োগ, গবেষণা ইত্যাদি বর্ধনে।

ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী ।। পরিচালক, জ্বালানি ও টেকসই গবেষণা ইন্সটিটিউট; অধ্যাপক, তড়িৎকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

Link copied