স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের অবদান কতটুকু?

Be-Nazir Ahmed

০৫ নভেম্বর ২০২২, ০৯:২৩ এএম


স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের অবদান কতটুকু?

ছবি : সংগৃহীত

দেশে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রবৃদ্ধি বিস্ময়কর। দুই যুগে সংখ্যার প্রবৃদ্ধি ৮০০ শতাংশ। বছর চল্লিশেক আগে দেশে মেডিকেল ছিল ৮টি এখন তা শতের উপর; এগুলো যে বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল না তা নয়; এখন জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের চিকিৎসকের সংখ্যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাপকাঠিতে দক্ষিণ এশিয়াতেও তলানির দিকে। কিন্তু তাই বলে মানহীন মেডিকেল কলেজ করে যে মানের চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে তা স্বাস্থ্যসেবায় হিতে বিপরীত ফল বয়ে আনবে।

অনেক বেসরকারি এমনকি সরকারি মেডিকেল কলেজেও প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। এমন অনেক সরকারি মেডিকেল কলেজও আছে যেখানে একটি বিভাগে সেই বিষয়ে স্নাতকোত্তর একজন শিক্ষকও নেই।

শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে শেখানোর জন্য ল্যাবরেটরি নেই, যন্ত্রপাতি নেই। যে ওয়ার্ডগুলো শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা শিক্ষার লাইব্রেরি, রোগী ধরে ধরে পাঠ করার কথা, সেখানে অধ্যাপকের যাওয়ার ফুরসত মেলে না। নিবন্ধকদের রোগী সামলাতে, তৈলবাজি করতে, সংগঠন করতে করতেই সময় গায়েব।

আরও পড়ুন : জীবন নিয়ে খেলা! 

চটি বই পড়ে, প্রাইভেট পড়ে ধরে-টরে এমবিবিএস পাস হলে একটি সনদ মিলবে, বিএমডিসির নিবন্ধনে রোগী দেখে পয়সাকড়িও বিস্তর হবে কিন্তু মানবিক মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা হবে না।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অবস্থা তো ভয়াবহ; প্রভাবশালী ব্যক্তিরা চোখের নিমিষে একেকটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কাড়ি কাড়ি অর্থ নিচ্ছেন কিন্তু শিক্ষায় লবডঙ্কা।

প্রয়োজনীয় শিক্ষকের কথা বাদই দিলাম, ন্যূনতম অবকাঠামো শিক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে তাদের সামান্য বিবেকও নেই। ভাড়া করা বই, চেয়ার, টেবিল, মাইক্রোস্কোপ দেখিয়ে তারা পরিদর্শক দলকে ধোঁকা দিতে চায়।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অবস্থা তো ভয়াবহ; প্রভাবশালী ব্যক্তিরা চোখের নিমিষে একেকটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কাড়ি কাড়ি অর্থ নিচ্ছেন কিন্তু শিক্ষায় লবডঙ্কা।

যে রোগী দেখে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, যে রোগী না দেখলে তার চিকিৎসা শিক্ষার বারো আনাই মিছে; চিকিৎসা শিক্ষার্থীদের সেই রোগীর গায়ে হাত দেওয়া তো দূরের কথা কেবিনের দরজা দিয়ে দর্শন করতে পারাও ভাগ্যের ব্যাপার।

ওয়ার্ডহীন বেশিরভাগ মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ব্যক্তিরা অপ-ডাক্তার হবে ডাক্তার নয়। চিকিৎসা সহায়ক প্রতিষ্ঠান নার্সিং কলেজ, প্যারামেডিকেল ইন্সটিটিউট, হেলথ টেকনোলজি ইন্সটিটিউট, এদের মানের কথা আর কী বলবো।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলো নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান, সনদ প্রদান করে মাত্র। সব মিলিয়ে চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মানোন্নয়ন করে সমমানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ না নিলে, বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবা হুমকির মুখে পড়বে।

আরও পড়ুন : অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক সিলগালা : বেটার লেট দ্যান নেভার 

অনুরূপভাবে দেশে মানহীন হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এবং ওষুধের দোকান ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে। অনুমোদিনহীনতা থেকে যত প্রকার অনিয়ম সম্ভব তার সবই হচ্ছে খোদ রাজধানী থেকে দেশের গাঁওগেরামে।

চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার শিকার হয়ে অসহায় মানুষেরা জান ও মাল দুটোই হারাচ্ছে। অনেকের কাছেই চিকিৎসা ব্যবসায় বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক বলে ছোট-বড় সকলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছেন হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ও ওষুধের দোকান দিতে।

দেশের এমন কোনো বড় ব্যবসায়ী পাওয়া যাবে না যাদের এগুলোর এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠান নেই। সমস্যা হচ্ছে এগুলোর মান নিয়ে, সমস্যা হচ্ছে এদের সেবাদান প্রতিষ্ঠানের বদলে বাণিজ্য মূল উপজীব্য হওয়ায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের প্রতারণ ও দুর্নীতিতেও যুক্ত হচ্ছে।

নকল ওষুধ বছরের পর বছর তৈরি হয়েছে যাতে ওষুধ নেই, আছে আটা-ময়দা। ঢাকার মিটফোর্ডে এমন ওষুধ মাঝে মধ্যে ধরা পড়ছে। কথা হলো এর শেষ কোথায়‍?

অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার করে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ, হুমকিতে ফেলছে জীবন। কোনো কোনো উপজেলার কথা শোনা যায়, যেখানে বাচ্চাদের টনসিল পাওয়া যায় না, মহিলাদের জরায়ু সবই গায়েব। অর্থের জন্য অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাচ্চাদের টনসিল অপারেশন করা হচ্ছে, মহিলাদের জরায়ু ফেলে দেওয়া হচ্ছে।

সিজার প্রয়োজন নেই কিন্তু সিজার করানো হচ্ছে। যে রোগীর আইসিইউর প্রয়োজন নেই তাকে আইসিইউতে ঢুকিয়ে বিলের মিটার বনবন করে ঘোরানো হচ্ছে। এমনকি মৃত্যুর পরেও আইসিইউতে রেখে বিল বাড়ানোর কথা শোনা গেছে।

এমন নকল ওষুধ বছরের পর বছর তৈরি হয়েছে যাতে ওষুধ নেই, আছে আটা-ময়দা। ঢাকার মিটফোর্ডে এমন ওষুধ মাঝে মধ্যে ধরা পড়ছে। কথা হলো এর শেষ কোথায়‍? এভাবেই কি স্বাস্থ্য খাত সবদিকে অবনতির দিকে যাবে? ঘুরে দাঁড়াবার কি কোনো পথ নেই?

আরও পড়ুন : স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা রুখবে কে?

আমাদের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যবান জাতি, যার জন্য একটি মানসম্পন্ন সেবাধর্মী স্বাস্থ্য খাত গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে একটি বড়মাপের সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর, বিএমডিসি, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল পরিদপ্তরের সক্ষমতা হাজারগুণ বাড়াতে হবে।

স্বাস্থ্য উন্নয়নে রাজনৈতিক অঙ্গীকার করতে হবে বড় মাপের, স্বাস্থ্য বাজেট ব্যাপক বৃদ্ধি করে দেশের সিংহ ভাগ মানুষকে সরকারিভাবে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে হবে।

চিকিৎসা শিক্ষাকে মানসম্পন্ন ও সমমানের করতে হবে। মনে রাখতে হবে ন্যূনতম খরচে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না হলে টেকসই উন্নয়ন হবে ফাঁকা বুলি।

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক

Link copied