ঋণ খেলাপি সংস্কৃতি

Syed Ishtiaque Reza

১৫ নভেম্বর ২০২২, ০৯:৪৩ এএম


ঋণ খেলাপি সংস্কৃতি

ছবি : সংগৃহীত

ব্যবসায়ীদের ঋণ খেলাপি হওয়া অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। তবে যেটা অস্বাভাবিক, সেটা হচ্ছে যদি ব্যাংকিং ব্যবসায় খেলাপি ঋণের একটা সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি প্রচুর আছে আর আছে এমন অনেক ব্যবসায়ী যারা ধরেই নিয়েছে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধ না করলে কিছু হয় না।

সাধারণ সময়ে কিছু ব্যবসায়ী ঋণ খেলাপি হলেও, বাকিরা কিন্তু ঠিক সময়ে নিয়মমাফিক তাদের ঋণ পরিশোধ করেন। যার ফলে, ঋণ খেলাপিদের জন্য ব্যাংকগুলোর যে আর্থিক ক্ষতি হয়, সেটা পূরণ হয়ে যায় অন্য ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধ করার ফলে। কিন্তু বহু ব্যবসায়ী এক সঙ্গে ঋণ খেলাপি হয়ে উঠলে তার ক্ষতিপূরণ কঠিন হয়ে পড়ে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ব্যাংক খাতে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।

আরও পড়ুন : টাকা পাচারকারীর তালিকাটা অন্তত মানুষ জানুক 

খেলাপিতে পরিণত হয়েছে মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। কী ভয়ংকর চিত্র! আমাদের গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থা, যা এমনিতেই অনুৎপাদক সম্পদের সমস্যায় জর্জরিত, তার নাজুক অবস্থা বোঝা যায় এই বিপুল খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেখে। ব্যাংকগুলোর ঋণ দান সক্ষমতা হয়তো এক সময় কমে যেতে পারে এই কারণে।

বেসরকারি ব্যাংকগুলো যে ঋণ বিতরণ করছে, তার ৬ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা মোট ঋণের ২৩ শতাংশই খেলাপি।

বেসরকারি ব্যাংকগুলো যে ঋণ বিতরণ করছে, তার ৬ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা মোট ঋণের ২৩ শতাংশই খেলাপি। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৪ দশমিক ৭৭। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১২ শতাংশ খেলাপি। 

সারা পৃথিবীর মতো আমাদের দেশেও অধিকাংশ ব্যবসাই চলে ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত ঋণের ওপর ভিত্তি করে। এই ঋণভিত্তিক অর্থায়নের প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়ীদের ঋণের একটা নির্দিষ্ট অংশ নিয়মিত সুদ সমেত পরিশোধ করে চলতে হয়।

আরও পড়ুন : বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং বাংলাদেশ

যদি সেই নিয়মে ছেদ পড়ে, ঋণের উপর সুদের অঙ্কটা বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে যার পুরোটাই পরবর্তী কালে পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক। কোনো ব্যবসায়ী যদি তা না করতে পারেন, তা হলে তাকে ঋণ খেলাপি বলে চিহ্নিত করা হয়।

ব্যাংকাররা বলছেন, করোনার কারণে দুই বছর ঋণ পরিশোধে বড় ছাড় ছিল। কোনো টাকা ফেরত না দিলেও কেউ খেলাপি হননি। ২০২২ সালে এসব ছাড় অনেকটাই উঠে গেছে। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

২০২০-২১ সালে করোনা কালে বাংলাদেশ ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্ক এবং প্রকৃত ক্ষতি নিরূপণের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ঋণ ও আর্থিক সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু দেখা গেল এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাংকগুলো গড়ে এই সুবিধার আওতায় শ্রেণিকৃত ঋণ কম দেখিয়ে মুনাফা আয় করেছে।

সরকার করোনা ঝুঁকি মোকাবিলায় শিল্প ও সেবা খাত, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, রফতানিমুখী শিল্প, গার্মেন্টস, কৃষি সব মিলিয়ে লক্ষাধিক কোটি টাকার প্রণোদনা সুবিধা দিয়েছে। এসব ঋণের একটি বড় অংশ এখন অনাদায়ী বা খেলাপি ঋণে পরিণত হচ্ছে। বড় গ্রাহকেরা ব্যাংকের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নতুন কোনো জামানত ছাড়াই ঋণ বাড়িয়ে নিয়ে সরকারের প্রণোদনা সমন্বয় করছে। 

আরও পড়ুন : দেশে এত দুর্নীতি কেন? 

যে কথাটা শুরুতে বলেছি যে, ঋণ খেলাপি হতেই পারে একজন। কিন্তু একে ব্যবসার নিয়মে পরিণত করলে ব্যাংক খাতের সামগ্রিক সক্ষমতা, সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠে।

ব্যবসায়িক মহলের একটি অংশ ব্যবসায় লাভ না করে ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার মধ্যেই বড় ব্যবসা দেখছেন। ব্যাংকের টাকাতেই এদের দেশ বিদেশে বাড়ি, গাড়ি ও বিলাসী জীবন। শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রেখে ব্যাংকের টাকায় এরা আমোদ ফুর্তি করছে। 
এত বড় খেলাপি ঋণের চাপ নিয়ে ব্যাংকগুলো কীভাবে চলবে সেটা একটা প্রশ্ন।

ব্যবসায়িক মহলের একটি অংশ ব্যবসায় লাভ না করে ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার মধ্যেই বড় ব্যবসা দেখছেন। ব্যাংকের টাকাতেই এদের দেশ বিদেশে বাড়ি, গাড়ি ও বিলাসী জীবন...

সমস্যাটা হয় যে, যাদের ব্যবসা করার জন্য সত্যি ঋণের প্রয়োজন এবং যারা সত্যিকারের ব্যবসাই করেন তাদের জন্য নতুন ঋণ পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। 

তা হলে, এই মুহূর্তে করণীয় কী? প্রয়োজন অত্যন্ত দক্ষ ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা। সরকার আগামী কয়েক বছরের জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটি স্বাধীন কমিটি করতে পারে যা সত্যিকারের যৌক্তিক কারণে যারা ঋণ খেলাপি হয়েছে তাদের চিহ্নিত করবে। এদের ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় হলেও ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ করা এবং এদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের খবরদারি রহিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করাও একটি বড় অগ্রাধিকার। 

আমরা সবাই জানি দেশে অকার্যকর ঋণ বাড়ার প্রধান কারণ ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের অপারগতা। রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক প্রতিষ্ঠা করা, ব্যাক্তিখাতের ব্যাংকের মালিকদের পারিবারিক ও বংশগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করায় তারা ইচ্ছামতো ঋণ অনুমোদন দিয়েছে।

আরও পড়ুন : স্ট্যাগফ্লেশন : বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে? 

বেসিক ব্যাংক, হল মার্ক কেলেঙ্কারির মতো বড় ঘটনাগুলোয় যারা জড়িত তাদের প্রতি নমনীয় মনোভাব অনেককেই দুর্বিনীত করেছে। খেলাপি ঋণের একটা বিরাট অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে বলেও খবর হয়েছে। কাজেই অর্থনীতিতে খেলাপি ঋণের প্রভাব গভীরতর। 
অনাদায়ী ঋণ বাড়ার কারণ কিন্তু ছোট বা মাঝারি শিল্প নয়। বড় বড় নামীদামি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরাই নানা কায়দায় ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ ফেরত দিচ্ছে না।

সরকার যদি এইসব ঋণ খেলাপির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এবং দুই একজনকেও ফৌজদারি আইনের মাধ্যমে বড় সাজা দেয় তাহলে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পদের অধিকারী অসাধু শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নিশ্চিন্তে দিন কাটাতে পারবে না। 

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

Link copied