কেন থামছে না কিশোর অপরাধ?

Monira Nazmi Jahan

১২ মার্চ ২০২১, ০৯:৩৭ এএম


কেন থামছে না কিশোর অপরাধ?

ছবি : সংগৃহীত

পল্লীকবি জসীমউদ্দীন তার ‘তরুণ কিশোর’ কবিতায় লিখেছেন,

‘তরুণ কিশোর! তোমার জীবনে সবে এ ভোরের বেলা,
ভোরের বাতাস ভোরের কুসুমে জুড়েছে রঙের খেলা।’

আজ আমরা আলোচনা করব, কিশোরদের বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে। যেই বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের আচরণ পরিবর্তিত হয় এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক অবক্ষয়, সমাজ পরিবর্তন, সমাজের নানাবিধ অসঙ্গতি এবং অস্বাভাবিকতায় অনেক সময় খেই হারিয়ে ফেলে সেই উন্মাদনা অবক্ষয়ে রূপ নেয়।

অপরাধের পথে পা বাড়ায় সেই কিশোরদের কেউ কেউ। যে বয়সে তাদের চপলতা, উচ্ছ্বাসে মেতে থাকার কথা, সেই বয়সে তারা জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অপরাধে। নিজেদের হারিয়ে ফেলে অপরাধের চোরাগলিতে। কখনো কি আমরা চিন্তা করেছি, কেন একজন কিশোর জড়িয়ে পড়ছে অপরাধের ভয়ংকর জগতে? কিশোরের ভুল পথে পরিচালিত হওয়ার দায় কার?

ক'জন কিশোরের ভুল পথে পা বাড়ানোর দায় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কেউ এড়াতে পারে না। জন্মগতভাবে কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায় না বরং বিভিন্ন পরিবেশ, বিভিন্ন পরিস্থিতি, বিভিন্ন ঘটনা তাকে অপরাধের রাস্তায় ধাবিত করে।

পরিবারের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে যদি আমরা দেখি তাহলে দেখব, পুঁজিবাদের এই যুগে অনেক অভিভাবকই ঊর্ধ্বশ্বাসে অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা প্রভৃতির পেছনে ছুটছেন। তারা ব্যস্ততার কারণে সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছেন না। একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা, হতাশা জেঁকে বসছে সন্তানের মনে। 

এই হতাশা থেকে উত্তরণের জন্য সন্তান ঝুঁকে পড়ছে আকাশ সংস্কৃতি এবং ইন্টারনেটের দিকে। যেহেতু প্রতিটি প্রযুক্তির মতো এই আকাশ সংস্কৃতি এবং ইন্টারনেটের রয়েছে কিছু অকল্যাণকর দিক এবং পরিবারের সদস্যদের নির্দেশনা দেওয়ার মতো সময় নেই, তাই তারা সঠিক নির্দেশনার অভাবে জড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন গ্যাং কিংবা মাদককেন্দ্রিক কোনো গ্রুপে। শুধু মাদক বা গ্যাং কালচার নয়, ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে আরও বিভিন্ন প্রকার সাইবার ক্রাইমে জড়িয়ে পড়ছে তারা।

পুঁজিবাদের এই যুগে অনেক অভিভাবকই ঊর্ধ্বশ্বাসে অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা প্রভৃতির পেছনে ছুটছেন। তারা ব্যস্ততার কারণে সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছেন না। একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা, হতাশা জেঁকে বসছে সন্তানের মনে।

আকাশ সংস্কৃতির কুপ্রভাব কিশোরদের বিপথগামী করে তুলছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে জেনেছি, বিদেশি এক চ্যানেলে প্রচারিত অনুষ্ঠান ক্রাইম পেট্রোল দেখে বিভিন্ন কিশোরের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার গল্প।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, পরিবার থেকে সঠিক প্যারেন্টিং পেলে হয়তো অপরাধে জড়িয়ে পড়া কিশোরটি বিপথগামী হতো না। অভিভাবকদের সঠিক নির্দেশনা অনেক ক্ষেত্রে একজন কিশোরকে বিপথগামী পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট।

সমাজে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে যদি আমরা দেখি তাহলে দেখব, সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ধর্মীয় মাহফিলের নামে চলছে অন্য ধর্ম, গোত্র, বর্ণের মানুষের প্রতি ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানোর প্রতিযোগিতা, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে।

যে কিশোরটি এই ধরনের সমাজে বেড়ে উঠবে, খুব স্বাভাবিকভাবে তার মধ্যে উগ্র সাম্প্রদায়িক চর্চা বেড়ে যাবে। অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণার বিষবাষ্প তার মধ্যেও লালিত হতে থাকবে, ফলে সেই কিশোরটি জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদের মতো ভয়াবহ অপরাধে।

হলি আর্টিজানের ঘটনার সময় দেখেছি, কিশোরদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার করুণ পরিণতি। আমাদের সমাজের বিভিন্ন ভয়াবহ দিক একজন কিশোরকে অপরাধে উৎসাহিত করে। আমাদের সমাজে যখন কোনো নারীর প্রতি সহিংসতা ঘটে তখন সমাজের এক শ্রেণির মানুষ সেই নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতাকে বৈধতা দিতে যুক্তি দাঁড় করায়।

যখন একটি সমাজ কোনো অপরাধকে বৈধতা দেবে, তখন স্বাভাবিকভাবে সেই সমাজে বড় হতে থাকা কিশোরটি অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়বে। সেই সূত্র ধরেই আমরা দেখি, আমাদের কিশোররা নারীর প্রতি বিভিন্ন রকম সহিংসতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। একটি সমাজে যখন বিভিন্ন অজুহাতে সাংস্কৃতিক চর্চা বন্ধ করে দেওয়া হয়, যখন পাঠাগার, খেলার মাঠ, পার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন সেই সমাজের কিশোররা স্বভাবতই হতাশাগ্রস্ত হয়ে যায়। ফলে তারা মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে ধাবিত হয়।

রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার দিক থেকে চিন্তা করলে সবার আগে যে বিষয়টি উল্লেখ করতে হবে, তা হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আমরা প্রায়ই দেখতে পাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শক্তি প্রদর্শনের অস্ত্র হিসেবে কিশোরদের ব্যবহার করা হচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার দিক থেকে চিন্তা করলে সবার আগে যে বিষয়টি উল্লেখ করতে হবে, তা হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আমরা প্রায়ই দেখতে পাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শক্তি প্রদর্শনের অস্ত্র হিসেবে কিশোরদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক সময় অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে তাদেরকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ভাঙচুর, বোমাবাজিসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়। রাষ্ট্রের এই ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রভাবে কিশোররা বিপথে পা বাড়ায়।

একজন কিশোর যখন কোনো অপরাধ করে তখন তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। এই ধরনের সংশোধনাগারে পাঠানোর উদ্দেশ্য থাকে যেন কিশোরটি তার ভুল বুঝতে পেরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, এই সংশোধনাগারের পরিবেশ এতই ভয়াবহ যে, একজন কিশোর সংশোধন হওয়া তো দূরের কথা বরং সেখানে গিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার মতো ভয়াবহ ঘটনাও আমরা দেখতে পাই। কিশোর অপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে প্রবেশনারি অফিসার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ আমাদের দেশে নেই পর্যাপ্ত প্রবেশনারি অফিসার।

শিশু আইন ২০১৩’র  ৪৪ ধারা অনুযায়ী, শিশুদের গ্রেফতারের পর হাতকড়া পরানো বা কোমরে রশি ইত্যাদি পরানো নিষেধ এবং বলা হয়েছে গ্রেফতারের পর থেকে আদালতে হাজির করা পর্যন্ত শিশুকে প্রাপ্তবয়স্ক বা ইতোমধ্যে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এইরূপ কোনো শিশু বা অপরাধী এবং আইনের সংস্পর্শে আসা কোনো শিশুর সঙ্গে একত্রে রাখা যাবে না।

আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়গুলো আসলে কতটুকু মানছেন, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। আজকের কিশোর আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে, তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে কিশোরদের বিষয়ে রাষ্ট্র, সমাজ, অভিভাবক সকলকে সচেতন হতে হবে। কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের জন্য ‘অলটারনেটিভ মেজারস’ বা ‘বিকল্প ব্যবস্থা’র ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

মনিরা নাজমী জাহান ।। শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

Link copied