নিরাপদ-পুষ্টিকর খাদ্য : টেকসই উন্নয়নে স্মার্ট বাংলাদেশের অঙ্গীকার
![নিরাপদ-পুষ্টিকর খাদ্য : টেকসই উন্নয়নে স্মার্ট বাংলাদেশের অঙ্গীকার](https://cdn.dhakapost.com/media/imgAll/BG/2023February/dhakapost-20230202064543.jpg)
মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা সমূহের মধ্যে খাদ্যের অবস্থান সবার শীর্ষে। সৃষ্টির সূচনা থেকে বর্তমান শতাব্দীর জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান বিকাশের ফলে আমাদের খাবার ও খাদ্যাভ্যাসে এসেছে দারুণ সব বৈচিত্র্য। একই সঙ্গে নিরাপদ ও সঠিক পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবারের প্রতি গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের অন্যতম সূচক হলো জনগণের জন্য বছরব্যাপী পুষ্টি সমৃদ্ধ, নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে সরকারের নানামুখী তৎপরতায় দেশীয় খাদ্যের উৎপাদনও বেড়েছে সমান তালে। সাম্প্রতিককালে দেশের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর খাদ্যের ঘাটতি না থাকলেও নিরাপদ ও পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্যের প্রতি মানুষের যথেষ্ট আগ্রহ ও চাহিদা বেড়েছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি২) ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা মুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা, উন্নত পুষ্টির পাশাপাশি টেকসই কৃষি ব্যবস্থা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা আছে। সুস্থ-সবল সমৃদ্ধ জাতি গঠনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম টার্গেট (২.১) সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য বিশেষ করে দুগ্ধ পোষ্য শিশু, গরিব ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ক্ষুধার অবসান এবং বছরব্যাপী পর্যাপ্ত নিরাপদ, পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে চলছে।
২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে অপুষ্টির প্রাদুর্ভাব শতকরা ১০ ভাগে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছে। ২০১৬ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে অপুষ্টির হার বাৎসরিক শতকরা এক ভাগ হ্রাস এই সফলতার অন্যতম প্রমাণ।
পাঁচ বছর বয়সের নিচের শিশুদের অপুষ্টির হার পরিমাপের গুরুত্বপূর্ণ দুটি নির্দেশক হলো স্টান্টিং ও ওয়াস্টিং। শিশুর বয়স অনুযায়ী অস্বাভাবিক কম শারীরিক উচ্চতা হলে তাকে স্টান্টেড বলে। অপরদিকে উচ্চতা অনুযায়ী অস্বাভাবিক কম ওজনকেই ওয়াস্টিং বলা হয়। আইসিডিডিআর,বি’র তথ্য অনুযায়ী, দেশে শতকরা ২৮ ভাগ শিশু স্টান্টিংয়ের স্বীকার। ২০৩০ সালের মধ্যে (এসডিজি ২.২ অনুযায়ী) স্টান্টিং শিশুর শতকরা হার ১৫ ভাগে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগ সচেষ্ট রয়েছে। তাছাড়া, গর্ভবতী মায়েদের রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনতে পারার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। ফলে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাসের মাধ্যমে সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যের অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে।
২০৪১ সালের মধ্যে সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে যে চারটি ভিত্তির কথা উল্লেখ আছে সেগুলো হলো- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্মেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি। স্মার্ট সিটিজেনরাই মূলত আধুনিক সুবিধা সম্বলিত স্বাস্থ্যকর ও টেকসই পরিবেশে নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যাভ্যাসে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রধান কারিগর হবেন।
সাম্প্রতিক করোনা মহামারি, বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ফসলের উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশই চিন্তিত। একবিংশ শতাব্দীতে একটি দেশের নাগরিকদের মানসম্পন্ন নিরাপদ, পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা মেটানোর ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলাটা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এই অনিশ্চয়তা থেকে উত্তরণের জন্য গবেষক ও বিজ্ঞানীরা মানুষের জন্য নিরবচ্ছিন্ন নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার সরবরাহের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলার বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ সকল প্রযুক্তির মাধ্যমে মূল উদ্দেশ্য অল্প জমিতে সহজেই অধিক পরিমাণে নিরাপদ পুষ্টি সম্পন্ন খাদ্যের চাহিদা মেটানো।
পৃথিবীতে বর্তমানে নিরাপদ ও পুষ্টি সম্মত খাদ্যের যে চাহিদা তৈরি হয়েছে তা পূরণের জন্য বিভিন্ন স্মার্ট প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ হচ্ছে। এ সকল প্রযুক্তির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তি হলো স্মার্ট ভার্টিক্যাল ফার্মিং বা উলম্ব খামার ব্যবস্থাপনা। এ প্রযুক্তিতে রাষ্ট্রের স্মার্ট নাগরিকেরা তাদের চাহিদার প্রায় সকল খাদ্যই পছন্দ অনুযায়ী নিজেরা উৎপাদন করবে। প্রথাগত ছাদ বাগানের সাথে এই প্রযুক্তির মূল পার্থক্য হলো- স্মার্ট ভার্টিক্যাল খামারে নাগরিকদের চাহিদানুযায়ী প্রয়োজনীয় সব ধরনের (বিশেষ করে শস্য ও ডাল জাতীয় স্টাপল ফুড) খাদ্য পরিমাণ মতো, মানসম্মত ও নিরাপদ উপায়ে উৎপাদিত হবে। অপরদিকে ছাদ বাগানে মূলত অবসর সময়ে নিজস্ব চাহিদার কিছু অংশ শাক-সবজি বা মৌসুমি ফল উৎপাদন করা হয়। স্মার্ট ভার্টিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে একটি দেশের নাগরিকদের খাদ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য বৈদেশিক সরবরাহের উপর নির্ভরতা কমার পাশাপাশি খাদ্য পরিবহনের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণও হ্রাস পাবে।
এছাড়াও কৃত্রিম আলোর ব্যবহার ও গবেষণাগারে খাবার উৎপাদনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ স্মার্ট মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদার একটা বড় অংশ পূরণ হবে। ইতোমধ্যেই ল্যাবে তৈরি মুরগির মাংস কিংবা হাম বার্গার মানুষের মাঝে বেশ আলোচনা ও কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে।
স্মার্ট নাগরিকদের খাদ্যের আরো এক সহজ লভ্য উৎস থ্রিডি ফুড প্রিন্টিং। থ্রিডি ফুড প্রিন্টিং প্রযুক্তিতে মূলত যেকোনো খাবার রান্নার পরিবর্তে থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে প্রস্তুত করে পরিবেশন করা যায়। এ ধরনের খাবার তৈরিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উৎপাদিত খাদ্য পণ্যসমূহ হাতের স্পর্শ ছাড়াই নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ভোক্তার নিকট পৌঁছায়। এসব প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়াও খাবারকে নিরাপদ, পুষ্টিসমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যকর করার আরও অনেক প্রযুক্তি রয়েছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অভীষ্ট লক্ষ্যসমূহ অর্জিত হবে। একইসাথে ভবিষ্যৎ স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে এ সকল প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশ হবে স্বপ্নের সোনার স্মার্ট বাংলাদেশ।
মো. নাজমুল ইসলাম ।। জেলা নিরাপদ খাদ্য অফিসার, ঝালকাঠি