চিকিৎসা : সেবামুখী নাকি ব্যবসামুখী?

Be-Nazir Ahmed

০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:২৮ এএম


চিকিৎসা : সেবামুখী নাকি ব্যবসামুখী?

ছবি : সংগৃহীত

টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি। দুই পরাশক্তি ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যে চলছে সর্বময় ধর্মঘট। করোনাপর্বে ও করোনাউত্তর বিশ্বে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। তাতে অনুষঙ্গ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।

খাদ্যাভাব, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, জীবনযাপন ব্যয় বৃদ্ধি, লোডশেডিংয়ের ন্যায় কর্মী ছাঁটাই, আবহাওয়ার যাচ্ছেতাই আচরণ সবমিলিয়ে অস্থির এক সময়ের নোঙরহীন নৌকায় আমরা।

আমার পাড়ায় টিসিবির ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ হচ্ছে মানুষের সারি, নিম্নবিত্তদের সাথে যুক্ত হচ্ছে নিম্নমধ্যবিত্তরা। সুবেশ মানুষের অনিচ্ছা মুখোশে রোদ্রতপ্ত মুখমণ্ডল। চাকরিহারা মানুষেরা দুর্বার আকর্ষণের মহানগরী ছেড়ে গ্রামমুখী। প্রশ্ন ক্রমাগত বাড়ছে!

আরও পড়ুন >>> জীবন নিয়ে খেলা! 

আমরা এখন কোথায়, কোন দিকে ধাবমান আমাদের যাপিত জীবন। এতসব অনিরাপত্তার মাঝে চিকিৎসার খোঁজ রাখে কে? জনস্বাস্থ্যের বাজেটে পড়ছে কোপ, সংক্রামক-অসংক্রামক নির্বিশেষ কী নেবে তার সুযোগ, ঝোপে মারবে মরণ কোপ।

অনাদিকাল থেকে সংক্রামক রোগে বিরাজ করছে অপুষ্টি ও সংক্রমণের দুষ্ট চক্র। আবার কি ফিরে আসছে তা এই বাংলায়? সংক্রমণ প্রশমনে শতেক অ্যান্টিবায়োটিক, অসংক্রামক রোগে হাজারও নিদান। দাম তাদের আকাশ ছোঁয়া।

ওষুধের সাথে বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য ব্যয়ে যুক্ত হয়েছে অনাবশ্যক সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাদের মূল্যও অযৌক্তিকভাবে বেশি। সব মিলিয়ে চিকিৎসা সেবা গ্রহণে জনগণের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।

মধ্যবিত্তদেরই হাতে ছ্যাঁকা লাগে দারুণ সব মোড়কবাজ নিদানে। তাহলে সমান তালে আক্রান্ত নিম্নবিত্ত, বিত্তহীনেরা কোথায়? কে খবর রাখে তাদের, যারা সদা বাণিজ্যমুখী।

গ্রাম থেকে রাজধানী অবধি চিকিৎসায় বাণিজ্য জাল বিস্তৃত, একবার রোগে পড়লে ইলিশের ন্যায় তা ধরা খায়, ছটপটে পটল তোলে। আগুনে আবার ঘৃত যুক্ত হয়েছে, ওষুধের ক্রমাগত মূল্য বৃদ্ধি।

আরও পড়ুন >>> অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক সিলগালা : বেটার লেট দ্যান নেভার 

এমনিতেই আমাদের রোগীরা ডাক্তারের লেখা সব ওষুধ কেনে না, বিশটা অ্যান্টিবায়োটিক লিখলে পাঁচটা কেনে। এখন পড়েছে শাঁখের করাতে, পকেটে টঙ্কার ঘাটতি অন্যদিকে আকাশচুম্বী ওষুধের দাম। তাদের জন্য একটা সমাধান হলো অ্যান্টিবায়োটিক একটাও না কেনা, অথবা চিকিৎসার উল্টো পথে হাঁটা।

জনস্বাস্থ্যে বাজেটের ঘাটতিতে ম্যালেরিয়া, কালা জ্বরসহ বিরাজিত নানান সংক্রামক রোগে অতীতের ন্যায় আত্মাহুতি অবান্তর কথ্য নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, রোহিঙ্গা ও তদসংলগ্ন এলাকায় ডিপথেরিয়া রোগের তাণ্ডবের কথা অথবা চট্টগ্রামে হামের করুণ কাহিনি।

আবারও স্মরণ করতে চাই অপুষ্টি ও সংক্রমণ দুষ্ট চক্রের কথা। সুষম ও অপর্যাপ্ত খাদ্যে উৎসারিত অপুষ্টি সংক্রমণের জোগান বাড়াবে। সেই ক্ষেত্রে ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানান জলবাহিত রোগ, যক্ষ্মাসহ নানান রোগ অপুষ্ট জনমানুষ আক্রান্ত করবে এবং দুষ্টচক্রের অনিবার্য পরিণতিতে আরও অপুষ্ট করবে।

ওষুধের সাথে বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য ব্যয়ে যুক্ত হয়েছে অনাবশ্যক সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাদের মূল্যও অযৌক্তিকভাবে বেশি। সব মিলিয়ে চিকিৎসা সেবা গ্রহণে জনগণের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।

আরও পড়ুন >>> স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা রুখবে কে?

সংক্রামক রোগে তবুও বেঁচে গেলে, রোগের পরিসমাপ্তি আছে কিন্তু অসংক্রামক আজীবন সদস্য পদ নিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকবে। নিত্য ডজন-আধা ডজন দুর্মূল্য ওষুধের জোগান শুধু বিত্তহীন নয়, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের সাধ্যাতীত।

ব্যবসামুখী চিকিৎসা থেকে সেবামুখী চিকিৎসায় রূপান্তরিত হতে হবে। মনে রাখতে হবে উন্নয়নের নিরিখে স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ সর্বোত্তম বিনিয়োগ...

এমনকি মধ্যবিত্ত বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত মানুষদের সুসাধ্য নয় এবং এই ধরনের কোনো রোগ জটিলতায় পড়লে, আইসিইউবাসী হলে নিজে মৃত্যুর সাথে পরিবারের নিঃস্ব করে যান।

সরকারি হাসপাতালগুলো এখানে আপতকালীন সমাধান দিতে পারতো এবং আমাদের দৃষ্টি সীমায় তা দিয়েছে। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই।

অপ্রতুল ওষুধ, পরীক্ষার ব্যবস্থা এবং ইউজার ফি’র নামে ব্যবসায়িক ফন্দি সেই পথও করেছে রুদ্ধ। সুতরাং অমানিশা গাঢ়তর হচ্ছে জনমানুষের চিকিৎসায় সামগ্রিক মূল্য বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব। কে রুধিবে তারে?

আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যর্থ কেন?

বর্তমান বাস্তবতায় স্বাস্থ্য বাজেট ব্যাপক পরিমাণ বৃদ্ধি করে চিকিৎসা ক্ষেত্রের সামগ্রিক নেতিবাচক প্রভাব কমানো যেতে পারে। ইউজার ফি প্রত্যাহার করলে, বিত্তহীন মানুষেরা সেবার পরবর্তী ধাপে যেতে পারবে।

সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে করতে হবে। সব ওষুধ ও চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপচারের সব সামগ্রী সরকারিভাবে সরবরাহ করতে হবে।

ব্যবসামুখী চিকিৎসা থেকে সেবামুখী চিকিৎসায় রূপান্তরিত হতে হবে। মনে রাখতে হবে উন্নয়নের নিরিখে স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ সর্বোত্তম বিনিয়োগ। কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।  

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ।। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক

Link copied