বৈষম্যই যখন নিয়তি

Syed Ishtiaque Reza

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:২৬ এএম


বৈষম্যই যখন নিয়তি

ছবি : সংগৃহীত

কিছু মানুষের আয় অস্বাভাবিক বেড়েছে। তার মানে হলো, অন্য অনেকের আয় অস্বাভাবিক কমেছে। এটাই নিদারুণ কঠিন সত্য। ক্রেডিট সুইস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের তৈরি করা তথ্যভাণ্ডারের সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২২ সালের সংস্করণে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ২০২১ সালে দেশে ৫০ কোটি ডলার বা ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণের সম্পদ আছে—এমন ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ২১। আর করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২১ সালে দেশে ১০ কোটি টাকার বেশি সম্পদধারী ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪৩ শতাংশ।

দ্রুত ধনী হচ্ছে দেশের কিছু মানুষ এবং আমরা বেশ বুঝতে পারছি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত দরিদ্রের হার ছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ। কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ।

নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে এই নতুন দরিদ্র শ্রেণির সংখ্যা জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে দেশে সম্প্রতি অর্থনীতির যে অধোগতি দেখা যাচ্ছে তাতে এই হার আরও বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন >>> দুর্নীতি বনাম আইএমএফের ঋণ 

কিছু ব্যবসায়ী হঠাৎ করে সিঙ্গাপুরে গিয়ে দেশের অন্যতম ধনী হয়ে যান। আবার কিছু লোক দেশের টাকা নিয়ে গিয়ে ধনিক শ্রেণির তালিকায় বড় অবস্থানে যান, তার কোনো হিসাব কি আছে?

একদিকে এত এত ধনীর গল্প, আরেকদিকে দারিদ্র্যের হারের এমন বৃদ্ধি একটি কঠিন সত্যের সামনে দাঁড় করায় আমাদের। একটা সত্য হলো, এত ধনী বাড়ছে কিন্তু কর বাড়ছে না। 

এক বাংলাদেশের ভেতরে আসলে এখন আর্থিক বিচারে অনেকগুলো বাংলাদেশ। একটা শ্রেণি যারা দেশকে টাকা বানানোর মেশিন হিসেবে দেখছেন, তারা অর্থ আর সম্পদ এখান থেকে আহরণ করে ও পাচার করে বিদেশে বাড়ি গাড়ি করছেন।

কর জিডিপি অনুপাতে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্নেই অবস্থান করছি। কিন্তু আরেকটি বড় সত্য হলো আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে দ্রত গতিতে। বৈষম্য তো আগেও ছিল, বাড়ছিল সবসময়ই। কিন্তু এখনকার প্রকৃতি আগের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং অভূতপূর্ব।

এক বাংলাদেশের ভেতরে আসলে এখন আর্থিক বিচারে অনেকগুলো বাংলাদেশ। একটা শ্রেণি যারা দেশকে টাকা বানানোর মেশিন হিসেবে দেখছেন, তারা অর্থ আর সম্পদ এখান থেকে আহরণ করে ও পাচার করে বিদেশে বাড়ি গাড়ি করছেন।

আরও পড়ুন >>> বৈশ্বিক সংকট : দরকার মুদ্রানীতি ও বাজেটের যথাযথ সমন্বয় 

তাদেরই একটা অংশ আবার দেশের ভূমি, জলাভূমি, শহর, বন্দর, ব্যবসা বাণিজ্য আর ক্ষমতা কব্জা করে একটা ঝাঁ চকচকে জীবন উপভোগ করছেন। আর বাকিরা কেউ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত, কেউ নিম্নবিত্ত এবং বড় অংশ দারিদ্র্যসীমারও নিচে।  

বৈষম্যের এমন বাড়বাড়ন্ত কবে দেখেছে মানুষ সেটা মনে করতে পারছে না। তবে অর্থনীতির সূত্র বলে এগুলো বেশি বাড়ে সংকটের সময়ই যদি শাসন প্রণালীতে সমস্যা থাকে।

কোভিডের সময় যখন এক ধাক্কায় বহু মানুষের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে, ঠিক একই সময়ে এমন অবস্থায় একটা শ্রেণি তাদের সম্পদ ও অর্থ আরও বাড়িয়েছেন বা বাড়াতে পেরেছেন।

যুদ্ধের কারণে নতুন করে অর্থনীতি সঙ্গীন অবস্থায় পড়েছে এবং এবারও ধনীরা সম্পদ বাড়াতে পারছেন। কিন্তু অনেকে নতুন করে গরিব হয়ে যাচ্ছেন। এটি একটি নির্মম ব্যবস্থা। বহু মানুষের আয় কমে যাওয়া এবং অল্প কিছু মানুষের আয় ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার এমন বণ্টন ব্যবস্থা বড় নিষ্ঠুর। আমাদের অর্থনীতি একটা বড় সময় ধরে দেখছে প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয়। কিন্তু দরিদ্র মুখও সেই হারে দেখছে অর্থনীতি।

ক্রমবর্ধমান আয় পকেটে আসা ভাগ্যবানদের সৌভাগ্যের বহর বেড়েই চলেছে। সুইস ব্যাংকে জমার পরিমাণ যেমন বাড়ছে, তেমনি কানাডার বেগম পাড়ার পর এখন দুবাইয়ের আবাসন মার্কেট বাংলাদেশের নব্য ধনীদের নতুন ঠিকানা। আগে থেকেই আমেরিকা আর ইউরোপ তো ছিল, ছিল মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমও।

আরও পড়ুন >>> আইএমএফের ঋণ : ইতিহাস যা বলে 

বাংলাদেশে আয় ও বিত্তের বৈষম্যের মাত্রা খুবই বেশি এবং তা কেবলই ক্রমবর্ধমান। করোনা আর বিশ্বমন্দার ধাক্কায় অনেকে সর্বস্বান্ত হওয়ায় পরিস্থিতি নাজুক হয়েছে। এর ওপর ধনিক শ্রেণি পোষার সরকারি নীতি তো আছেই। 

মানুষ খুব স্পষ্ট করে জানতে চায় যে, করদাতাদের টাকায় যারা চলে তারা কেন ব্যাংকের লালবাতি জ্বালানো আটকাতে পারছে না এবং এসব কারণে কিছু বড় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রতি জনমানসে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

সাম্প্রতিক আর্থিক সংকট এবং তাতে ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অবস্থা মানুষের সামনে উন্মোচিত হয়েছে, তাতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ধনীদের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের মনে এক গভীর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের টাকার মালিক বনে কারা টাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলো, কারা টাকা পাচার করলো এই আলোচনা এখন সবখানে।

মানুষ খুব স্পষ্ট করে জানতে চায় যে, করদাতাদের টাকায় যারা চলে তারা কেন ব্যাংকের লালবাতি জ্বালানো আটকাতে পারছে না এবং এসব কারণে কিছু বড় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রতি জনমানসে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন >>> অর্থনৈতিক মন্দার শিকড় কোথায়?

আর্থিক বৈষম্য উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। এর থেকে তৈরি হয় ক্ষমতা বা প্রভাবের অসাম্য। আর ক্ষমতার অসাম্য যত বাড়ে, আদর্শ নীতি আর বাস্তবে যে নীতি অবলম্বন করা হয় এবং রূপায়িত করা হয়, তাদের মধ্যে ব্যবধানও তত বাড়ে।

আইনি ও বেআইনি, অনেক পথে ধনীদের রাজনৈতিক প্রভাব মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণির মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। তাই গণতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষের একটা করে ভোট থাকলেও, সব মানুষ সমান নয়।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

Link copied