স্মার্ট জনশক্তি-স্মার্ট বাংলাদেশের প্রধান ভিত্তি
আমেরিকার বিখ্যাত বিজনেস ম্যাগনেট ও ফিলোসফার জন. ডি. রকফেলার বলেছেন, ‘আমি চিন্তাবিদদের জাতি চাই না, শ্রমিকের জাতি চাই।’ অর্থাৎ সহজ কথায় চিন্তা করে বসে থাকলেই কোনো কাজ এগোবে না।
কাজকে সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের জন্য দরকার দক্ষ জনশক্তি। দক্ষ আর স্মার্ট জনশক্তিই আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। এতে করে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যা জনসম্পদে রূপান্তর করতে না পারলে তা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এই বোঝার চাপে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামো নানাভাবে বিপর্যস্ত হবে। দিনে দিনে ভয়াবহ সংকট আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবে। সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অপরাধপ্রবণতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মাদকাসক্তি প্রভৃতি বাড়তেই থাকবে।
আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি ফিরে আসার প্রত্যাশায়
জনবহুল একটি দেশের বেশিরভাগ নারী-পুরুষ যদি কর্মক্ষম এবং উপার্জনক্ষম হয়, তাহলে সেই দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি স্বাভাবিকভাবেই মজবুত হতে বাধ্য। আমাদের জনসংখ্যাকে বোঝা না ভেবে জনশক্তিতে রূপান্তরের চেষ্টা চালাতে হবে।
বিভিন্ন কর্মমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে তা জনসম্পদে পরিণত হবে। আমরা আমাদের জনসম্পদকে দেশের অভ্যন্তরে যেভাবে কাজে লাগায় না কেন, তা আমাদের জন্য সমৃদ্ধির নতুন বার্তা বয়ে আনবে এবং অর্থনীতিতে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করবে।
আলিবাবা (Alibaba.com)-এর ফাউন্ডার পৃথিবীর সেরা উদ্যোক্তাদের একজন জ্যাক মা (Jack Ma)। তিনি বলেছেন, ‘তুমি যদি ২১ শতকে জিততে চাও, তবে অবশ্যই তোমাকে অন্যদের উন্নতির জন্য কাজ করতে হবে।’ সুতরাং বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কাজ করা খুবই প্রয়োজন। তথাপি জনসংখ্যা স্মার্ট জনশক্তিতে রূপান্তর করাও অত্যন্ত সময়োপযোগী দাবি।
২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য নিয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ সরকার। এরই মধ্যে তা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। সরকার আগামীর বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, যেখানে প্রত্যেক জনশক্তি স্মার্ট হবে। সবাই প্রতিটি কাজ অনলাইনে করতে শিখবে, ইকোনমি হবে ই-ইকোনমি, যাতে সম্পূর্ণ অর্থ ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল ডিভাইসে করতে হবে।
আরও পড়ুন >>> উৎসবের সর্বজনীন অর্থনীতি
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নানা অনুষঙ্গ ধারণ করে তরুণদের প্রশিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হবে।
এই ধরনের ৫৭টি ল্যাব প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। ৬৪টি জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবিশন সেন্টার স্থাপন এবং ১০টি ডিজিটাল ভিলেজ স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। ৯২টি হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের নির্মাণ করা হচ্ছে।
সারা দেশে ছয় হাজার ৬৮৬টি ডিজিটাল সেন্টার এবং ১৩ হাজারের বেশি শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি এই চারটি মূল ভিত্তির ওপর গড়ে উঠবে ২০৪১ সাল নাগাদ একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ।
চতুর্থ বিপ্লবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে মানুষের বুদ্ধি ও ইচ্ছা শক্তি, কারখানার উৎপাদন, কৃষিকাজসহ যাবতীয় দৈনন্দিন কাজকর্ম ও বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। প্রস্তুতি চলছে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশে তৈরির।
আরও পড়ুন >>> রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি : এখনো শ্রমিক কেঁদে মরে
জনবহুল একটি দেশের বেশিরভাগ নারী-পুরুষ যদি কর্মক্ষম এবং উপার্জনক্ষম হয়, তাহলে সেই দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি স্বাভাবিকভাবেই মজবুত হতে বাধ্য। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট জনশক্তি তৈরি করতে তাই স্মার্ট শ্রমিক প্রয়োজন। এজন্য শ্রমিকদের স্বার্থও সংরক্ষণ করতে হবে।
একজন শ্রমিক উৎপাদন করে সমাজের জন্য, কিন্তু যখন তিনি আহত হন, তার দায়ভার তখন শুধু তার। তার প্রতিষ্ঠান, সরকার বা সমাজ তখন তার কোনো দায়িত্ব কতটুকু নেয়? তখন ওই পরিবারের জন্য বিষয়টি মর্মান্তিক হয়ে ওঠে।
বর্তমানে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশে চলে এসেছে। এজন্য আমাদের প্রস্তুতি থাকা আবশ্যক। কারণ, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিসহ সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার ওপর নজর রাখা হবে। দেশের আইনকানুন কী পর্যায়ে রয়েছে, কেমন রয়েছে তা বিবেচনা করা হবে।
সমস্যা হলো, শ্রম আইন বলতে আমরা কেবল পোশাকশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধিনিষেধগুলো চিন্তা করি। এই মানসিকতা থেকে খুব শিগগির বের হয়ে আসতে হবে। পোশাকশিল্পের বাইরেও শ্রমের অন্যান্য যে বড় খাত রয়েছে সেগুলো বিবেচনায় রেখে আগাতে হবে।
আরও পড়ুন >>> মরণ ফাঁদের নির্মাণকাজ
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য সবার জন্য কানেক্টিভিটি, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ই-গভর্নমেন্ট এবং আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি প্রমোশন এই চারটি সুনির্দিষ্ট প্রধান স্তম্ভ নির্ধারণ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হয়েছে।
সততা, সাহসিকতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে মাত্র ১৪ বছরের মধ্যে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে ৪০ শতাংশ বিদ্যুতের দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় এনেছেন। যেখানে লাখ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল, সজীব ওয়াজেদের যুগোপযোগী পরিকল্পনায় ও সুপরামর্শে ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি ইউনিয়ন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি এবং মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ১৮ কোটির বেশি।
জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে বর্তমানে সারা দেশে প্রায় আট হাজার ৮০০টি ডিজিটাল সেন্টারে প্রায় ১৬ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা কাজ করছেন, যেখানে ৫০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন। এর ফলে একদিকে নারী-পুরুষের বৈষম্য, অন্যদিকে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ও গ্রাম-শহরের বৈষম্য দূর হচ্ছে।
দেশে স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিকাশে ও স্টার্টআপদের উদ্ভাবনী সুযোগ কাজে লাগানোর পথ সুগম করতে সরকার আগামী পাঁচ বছরে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে।
আরও পড়ুন >>> স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নাই
মেধাবী তরুণ উদ্যোক্তাদের সুদ ও জামানতবিহীন ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট এবং ট্রেনিং, ইনকিউবেশন, মেন্টরিং এবং কোচিংসহ নানা সুবিধা দেওয়ার ফলে দেশে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। বিকাশ, নগদ, পাঠাও, চালডাল, শিওর ক্যাশ, সহজ, পেপারফ্লাইসহ দুই হাজার ৫০০ স্টার্টআপ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। যারা প্রায় আরও ১৫ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। ১০ বছর আগেও এই কালচারের সঙ্গে আমাদের তরুণরা পরিচিত ছিল না। মাত্র সাত বছরে এই খাতে ৭০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এসেছে।
বিশ্বে অনলাইন শ্রমশক্তিতে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালের আগে বাংলাদেশে সরকারি কোনো সেবাই ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সরকারি সব দপ্তরের প্রাথমিক সব তথ্য ও সেবা মিলছে ওয়েবসাইটে। সেই সঙ্গে সরকারি সব তথ্য যাচাই-বাছাই ও সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন সেবা ও আবেদনের যাবতীয় কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে।
এরই মধ্যে আমরা ইন্টার-অপারেবল ডিজিটাল ট্রানজেকশন প্ল্যাটফর্ম ‘বিনিময়’ চালু করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে গেছে প্রত্যেক গ্রাহকের হাতের মুঠোয়। ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে অনেক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে।
ফ্রিল্যান্সিং থেকে আসা অর্থ আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে আধুনিক ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সবকিছুই হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল।
আরও পড়ুন >>> শহর যেন মৃত্যুফাঁদ
ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ সর্বক্ষেত্রে দৃশ্যায়িত। সেই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে চলছে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের কর্মযজ্ঞ। প্রতিটি নাগরিকদের উচিত সেই অগ্রযাত্রায় শামিল হওয়া।
জীবনমান উন্নয়নের এই লড়াইয়ের মাধ্যম বিশ্বের বুকে যেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বাংলাদেশ তেমনি সুখে, শান্তিতে প্রতিটি নাগরিক পাবে সর্ব প্রকার অধিকার ভোগের সুযোগ। রাষ্ট্র রূপ নেবে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে। সবকিছু যেমন স্বপ্নের মতো তেমনি বাস্তবায়িত হওয়া সময়ের ব্যাপার এটাও সত্য।
এন আই আহমেদ সৈকত ।। সাবেক ছাত্রনেতা