অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে নগর স্বাস্থ্য!
বিশ্বের জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে জনসংখ্যার বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ১ দশমিক শূন্য ৩। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ছে নগরায়ন। নগর জনসংখ্যার এই হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
২০৪০ সালে দেশের জনসংখ্যা ২৩ কোটিতে উন্নীত হবে, যার অর্ধেকের বেশি (সাড়ে ১১ কোটি) বাস করবে নগরে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, নগরে ৩.২১ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগরে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধিও অন্যতম মূল কারণ হচ্ছে শহরগুলোয় উচ্চতর শিক্ষা সুবিধা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ।
এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরও অন্যতম কারণ। জ্যামিতিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ছে নগর অবকাঠামো। দ্রুত নগর অবকাঠামো বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ছে অপরিকল্পিত আবাসন। যদিও এইসব আবাসন নির্মাণের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট আইন ও নীতিমালা।
আরও পড়ুন >>> বঙ্গবাজারে আগুন : দোকান নয়, পুড়েছে লাখো মানুষের স্বপ্ন
তবে আইন ও নীতিমালার তোয়াক্কা না করে গড়ে উঠছে নতুন নতুন স্থাপনা। একটি বিল্ডিং নির্মাণের সময় কী ধরনের অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা রয়েছে তা উল্লেখ করেতে হয়।
বিএনবিসি (বাংলাদশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড) ও ফায়ার কোড অনুযায়ী ভবনের নিচতলায় ৫০ হাজার গ্যালন পানি সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। যদিও পাঁচ কাঠার একখণ্ড জমির মধ্যে ৫০ হাজার গ্যালন পানি রাখা সম্ভব না। একটি পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে রাজধানীর শতকরা ৮০ ভাগ ভবনই আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
আগুন লাগলে সরু রাস্তায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে না পারা ও পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ। ফলে বেড়েই চলেছে নগর স্বাস্থ্যের ঝুঁকি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আগুনজনিত দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স-এর বার্ষিক পরিসংখ্যান ডাটা অনুযায়ী (অগ্নি দুর্ঘটনার পরিসংখ্যার অনুয়ায়ী) মোট ২০টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। উক্ত তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যেসব কারণে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটছে তার অধিকাংশই নগরকেন্দ্রিক।
২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অগ্নি দুর্ঘটনাস্থল পর্যালোচনায় দেখা যায় শিল্প-প্রতিষ্ঠানে, বস্তিতে, গ্যাস সরবারহ লাইনে, সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ও মার্কেটে সবচেয়ে বেশি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে যার সবগুলো নগরে অবস্থিত। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৬৬ জন মানুষ।
২০২২ সালের সম্পদভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট ২৪১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে যার অধিকাংশ সংঘটিত হয়েছে নগরে। উল্লেখ্য যে, আবাসিক ভবনে, বহুতল ভবন, শপিং মল, পোশাক শিল্প কারখানা, গ্যাস লাইন ও বস্তিতে বেশি সংখ্যক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নগরের জনগোষ্ঠী।
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের এক পরিসংখ্যান বলছে, সারাদেশে বছরে আনুমানিক ৬ লাখ লোক আগুনে পুড়ে যায়। আগুনে পুড়ে গড়ে প্রতিদিন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসেন ২০ থেকে ২৫ জন।
আরও পড়ুন >>> শহর যেন মৃত্যুফাঁদ
অগ্নি দুর্ঘটনায় আহত লোকদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য সরকার ২০১৬ সালে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউড প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে উক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে এখন পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছে প্রায় ১ লাখ রোগী যার অধিকাংশই নগরের।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ৬ বছরে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৮৮ হাজারের মতো। এতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রাণহানি হয়েছে ১ হাজার ৪ শ’ জন, আহত হয়েছে অন্তত ৫ হাজার মানুষ।
সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বঙ্গবাজারের অগ্নি দুর্ঘটনা। এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় হতাহতের সংখ্যা থাকলেও ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সুগন্ধা নামের একটি লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকে আগুন লেগে কমপক্ষে ৩৮ জনের মৃত্যু হয়। ঐ বছরের জুলাই মাসে রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ-পূবে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জের একটি জুস তৈরির কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ৫২ জন নিহত ও ২০ জন আহত হন।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার কাছে একটি ফ্যানের কারাখানায় আগুন লাগে। যাতে কমপক্ষে ১০ জন মানুষ নিহত হন। আর ২০১৯ সালে পুরান ঢাকার একটি এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে ৭০ জনের প্রাণহানি হয়।
২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার উপকণ্ঠে একটি প্লস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১৩ জনের মৃত্যু ও অসংখ্য মানুষ আহত হন। ২০১২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের ইতিহাসে হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে। ঢাকার তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন শ্রমিক নিহত ও ১৫০ জনেরও বেশি আহত হন যা দেশ বিদেশে ব্যপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
আরও পড়ুন >>> এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ!
এর বাইরে ছোট ছোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিদিন। এসব অগ্নিকাণ্ডের সবগুলো সংঘটিত হয়েছে নগরে। উল্লেখিত এসব দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর প্রাথমিক বা তাৎক্ষণিক চিকিৎসা ছিল না বললেই চলে। টারশিয়াশি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে।
২০১৭ ও ২০১৮ সালে রাজধানীর ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে ২ হাজার ৬১২টি ভবনে জরিপ চালায় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৭৪টি ভবনে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা রয়েছে।
২ হাজার ৪৪৮টি ভবনে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থাই নেই এবং বাকি ৯০টি ভবনে রয়েছে সীমিত পরিসরে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রকাশিত বিবরণ থেকে জানা যায়, সারাদেশে ১৫৯৫টি শপিংমল ও মার্কেট পরিদর্শন করেছেন। এর মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৬৭৪টি, ঝুঁকিপূর্ণ ৮৯৭টি আর ২৪টি সন্তোষজনক। এই হিসাবের মধ্যে হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিদর্শন করা হয়েছে ৬শ ৯৯টি। এর মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ১৩৪টি, ঝুঁকিপূর্ণ ৫০২টি এবং সন্তোষজনক ৪৫টি।
অগ্নি দুর্ঘটনায় নগর স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্নক প্রভাব পড়ছে এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বড় বড় অগ্নি দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর সরকারি হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকে না। একমাত্র শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউড ব্যতীত বিশেষায়িত অন্য কোনো হাসপাতাল নেই।
যদিও সরকার টারশিয়ারি হাসপাতাল ও জেলা হাসপাতালগুলোয় বার্ন ইউনিট চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। যেহেতু অগ্নিদগ্ধ মানষুদের চিকিৎসা অন্য রোগীদের থেকে ভিন্ন তাই তাদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। বিশেষায়িত এই ধরনের চিকিৎসার জন্য নগর হাসপাতালগুলোয় নেই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবল। ফলে দিন দিন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্রুত নগরায়নের সাথে সাথে বাড়ছে অগ্নিঝুঁকি। যেহেতু নগরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ তাই আপাতত ফায়ার হাইড্রেন্ট নির্মাণ ও সচেতনতা বাড়ানোর উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা জরুরি।
আরও পড়ুন >>> যেটা দিতে পারব না, সেটা কেড়ে নেওয়ারও অধিকার নেই
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত নগরায়নে অগ্নি ঝুঁকির সাথে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি এই বিষয়টি নগরের নাগরিকদের বুঝাতে হবে। বিশেষ করে নগরের বড় বড় স্থাপনাগুলোর মধ্যে অগ্নি দুর্ঘটনা সংঘটিত হলে তাৎক্ষণিক উদ্ধার ও আক্রান্ত মানুষদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কীভাবে প্রদান করা যায় এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পরিবেশবিদদের মতে, নগরের অগ্নিকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করার জন্য পর্যাপ্ত গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, নগরের পরিসেবা বিকেন্দ্রিকরণ করে জনস্রোত কমাতে হবে।
সামগ্রিকভাবে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা জোরদার ও সুনিশ্চিত করা স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য দক্ষ জনবল ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার ।। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, অ্যামিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলাপমেন্ট কনসালটেন্ট, ইউনিসেফ এবং মোহাম্মদ মনিরুল হাসান ।। অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর, অ্যামিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলমেন্ট, ইউনিসেফ