মোখার তাণ্ডব : কৃষিখাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক

Shamiran Biswas

২০ মে ২০২৩, ০৮:৪৯ এএম


মোখার তাণ্ডব : কৃষিখাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক

ছবি : সংগৃহীত

বান্দরবানের মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষা নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে ধানক্ষেত, কলাবাগান, আমবাগান, রাবার বাগানসহ পাহাড়ি টিলাতে করা নানা প্রজাতির বাগানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালীন লতাজাতীয় সবজি ক্ষেতের ক্ষতি ব্যাপক।

ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে ঝড়ো ও দমকা হাওয়া চলাকালে উপজেলার ৫ ইউনিয়ন এলাকায় খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলেও বৃষ্টির কারণে ফসল মাটিতে নুয়ে পড়ায় এবং কাটা ধান ও গো খাদ্য ভিজে যাওয়ায় কৃষক এখন দুশ্চিন্তায় পড়ছে। পাশাপাশি ধান ও সবজি ক্ষেতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার রোমেন শর্মা জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে ক্ষতি থেকে পরিত্রাণের জন্যে সব ধরনের আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এছাড়া অনেকের কৃষি পণ্যের ক্ষতির কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, কৃষি প্রধান এই উপজেলায় সবজি, কলা আর ধান এই ৩ কৃষি পণ্যের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

আরও পড়ুন >>> ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ : বঙ্গোপসাগরে নয়, ঝড় তুলছে কফির কাপে

বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন এবং ইউপি সদস্য শাহাবুদ্দিন কৃষি পণ্যের ক্ষতির কথা জানান। নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আবছার ইমন বলেন, মোখার কারণে তার এলাকায় কৃষি ক্ষেতসহ শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালীন সবজি, কলাগাছ ও ধান ক্ষেতের ক্ষতি বেশি। 

কক্সবাজারে ক্ষয়ক্ষতি
ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের কৃষি অঞ্চল। জেলার টেকনাফ উপজেলা ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাড়িঘর উড়ে গেছে, ভেঙে গেছে গাছপালা। জেলায় কৃষিতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে টেকনাফে পানচাষিদের ক্ষতি হয়েছে সাড়ে ৩ কোটি টাকা।

ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের কৃষি অঞ্চল। জেলার টেকনাফ উপজেলা ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাড়িঘর উড়ে গেছে, ভেঙে গেছে গাছপালা।

সেন্টমার্টিনের ৭৫ শতাংশ গাছপালা ভেঙে গেছে। মাঠে কাজ করার সময় কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ২ হাজার ৮০০ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

ঘূর্ণিঝড়ে কৃষি খাতের ক্ষতি সম্পর্কে কক্সবাজারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কবির হোসেন জানান, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে জেলার কৃষিতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩ হাজার ৫২০ জন কৃষকের কৃষি খাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। তার মধ্যে ১ হাজার ৭০ জন পানচাষির ক্ষতি ৩৮৯ কোটি টাকা, ২ হাজার ৪৫০ জন গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষির ক্ষতি ৭৫৫ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পান চাষাবাদে প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। কেননা এবার ৩ হাজার হেক্টর জমিতে পান চাষ করা হয়েছে। আক্রান্ত জমির পরিমাণ ১৮৩ দশমিক ৫ হেক্টর। সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৪০ হেক্টর। আংশিক ক্ষতি ১৪৩ দশমিক ৫ হেক্টর।

আরও পড়ুন >>> ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং : প্রস্তুতি ও মোকাবিলা জরুরি

মোখার তাণ্ডবে গ্রীষ্মকালীন জমির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি। আক্রান্ত হয়েছে ১৬২ দশমিক ৫ হেক্টর জমি। তাতে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০ হেক্টর ও আংশিক ক্ষতি ১৫২ দশমিক ৫ হেক্টর জমি। শতকরা হিসাবে ৪ দশমিক ৬২ ও আংশিক ক্ষতি ৪৫ দশমিক ৯৪ হেক্টর জমি। টাকার অঙ্কে ৭৫৫ কোটি টাকা।

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সেন্টমার্টিন
দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, সেন্টমার্টিনে ১ হাজার ২০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনো প্রাণহানি হয়নি। তবে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পশ্চিমপাড়া, উত্তরপাড়া, কোনারপাড়া, গলাচিপা, মাঝেরপাড়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব অঞ্চলের মানুষ এখন স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে।

সেন্টমার্টিনের ৭৫ শতাংশ গাছপালা ভেঙে গেছে। মাঠে কাজ করার সময় কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ২ হাজার ৮০০ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ক্ষয়ক্ষতি
মোখার আঘাতে কক্সবাজারের উখিয়ার ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ২ হাজার ৮২৬টি ঘর ছাড়াও লার্নিং শেল্টার, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রসহ অন্যান্য ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ৭ রোহিঙ্গা আহত হয়েছেন।

এছাড়া কক্সবাজারের মহেশখালীতে ঘূর্ণিঝড় মোখার সময় লবণের মাঠে কাজ করতে গিয়ে তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।

আরও পড়ুন >>> আধিপত্য নয়, বন্ধুত্ব করি প্রকৃতির সঙ্গে 

মোখার মতো দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষার জন্য 
ধান ৮০ শতাংশ পরিপক্ব হয়ে গেলে দ্রুত সংগ্রহ করা, সংগ্রহ করা ফসল নিরাপদে সরানো না গেলে মাঠে গাদা করে পলিথিন শিট দিয়ে ঢেকে ভারি বৃষ্টিপাত থেকে রক্ষা করা, দ্রুত পরিপক্ব সবজি ও ফল সংগ্রহ করা, সার ও বালাইনাশক প্রয়োগ থেকে বিরত থাকা, দণ্ডায়মান ফসল পানির স্রোত থেকে রক্ষার জন্য জমির আইল উঁচু করে দেওয়া, নিষ্কাশন নালা পরিষ্কার রাখতে হবে যাতে পানি সহজে জমি থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, খামার জাত সব পণ্য নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে।

আখ, কলা এবং অন্যান্য উদ্যান তাত্ত্বিক ফসল এবং সবজির জন্য খুঁটির ব্যবস্থা করতে হবে, পুকুরের চারপাশে জাল দিয়ে ঘের করে দিতে হবে, গবাদি পশু শুকনো ও নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে হবে, মৎস্যজীবীদের সমুদ্র গমন থেকে বিরত থাকতে হবে, সব শেষ হালনাগাদ আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানতে হবে।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসন ও তাদের আর্থিক নিরাপত্তা জরুরি। পাশাপাশি সবধরনের সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে থাকে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে, বিশেষ করে বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কৃষকরা অল্প সময়ের মধ্যে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।

সমীরণ বিশ্বাস ।। কৃষিবিদ
[email protected]

Link copied