যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স : আমরা কীভাবে কাজে লাগাচ্ছি?

Dhaka Post Desk

নন্দিতা রায়

২২ মে ২০২৩, ০২:৫৬ পিএম


যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স : আমরা কীভাবে কাজে লাগাচ্ছি?

ছবি : সংগৃহীত

অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সৌদি আরবের মতো প্রতিষ্ঠিত দেশগুলো ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স সরবরাহকারী দেশ।

যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশে বিদেশে কর্মরত বিপুল সংখ্যক প্রবাসীদের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্সের শীর্ষ সুবিধাভোগীদের মধ্যে একটি। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। কোভিড-১৯ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে থমকে যাওয়া রেমিট্যান্স প্রবাহ মহামারি পরবর্তী পুনরুদ্ধারের সময় ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই থেকে এপ্রিল) দেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে এক হাজার ৭৭২ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আয় বেড়েছে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে প্রবাসী আয় ছিল এক হাজার ৭৩০ কোটি ডলার।

আরও পড়ুন >>> আইএমএফের ঋণ : ইতিহাস যা বলে 

সৌদি আরবে ২০ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করলেও যুক্তরাষ্ট্রে আছেন মাত্র ৫ লাখ বাংলাদেশি। অতীতে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকরা দেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে চলতি অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি অর্থ বিদেশে পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের পুরো পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। প্রবাসীদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ এনেছে সৌদি আরব, ৪৫৪ কোটি ডলার। ৩৪৪ কোটি ডলার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক আয় ছিল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ২০৭ কোটি ডলার নিয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ ছিল।

সম্প্রতি, প্যাটার্নটি পরিবর্তিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ও কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৩০৪ কোটি ৭৩ লাখ মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন। এছাড়া প্রবাসী আয়ের দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩০৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার আয় করেছে সৌদি আরব। ২৪০ কোটি ৮৫ লাখ মার্কিন ডলার নিয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা ৮৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৯৬ কোটি ৬৮ লাখ ৯০ হাজার ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের সামগ্রিক মুনাফা বিবেচনায় দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস।

আরও পড়ুন >>> অর্থনৈতিক মন্দার শিকড় কোথায়?

বিপরীতে, একই সময়ে, সৌদি আরব প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বার্ষিক ১৯.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৯১০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২২ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশগুলোর মধ্যে ৯৯৯ দশমিক ৭৬ মিলিয়ন ডলার নিয়ে প্রথম অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সৌদি আরব।

যুক্তরাষ্ট্রের রেমিট্যান্স বাড়ছে কেন?

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৩০৪ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। যেমন—কোভিড-১৯ সুবিধা—যুক্তরাষ্ট্র সরকার মহামারির ফলে চাকরি হারানো ব্যক্তিদের বিশেষ ক্ষতিপূরণ দিয়েছে, যা রেমিট্যান্স প্রবাহকে বাড়িয়ে তুলেছে কারণ প্রবাসীদের আয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তুলনায় বেশি ছিল।

বৈধ চ্যানেল এবং প্রণোদনা—অফিসিয়াল ব্যাংকিং চ্যানেলগুলোর প্রাধান্য এবং বৈধ চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের সরলতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদের তাদের আয় দেশে প্রেরণে উত্সাহিত করেছে, যা সামগ্রিক রেমিট্যান্স প্রবাহের জন্য ভালো। উপরন্তু, হুন্ডি পদ্ধতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় না।

বাংলাদেশ সরকার ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণের জন্য প্রণোদনার হার ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২.৫ শতাংশ করেছে। প্রবাসীরা তাই অনুমোদিত পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণে আরও অনুপ্রাণিত হয়েছে।

শিক্ষা-সম্পর্কিত অভিবাসন—যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক নিচ্ছে, যা প্রবাসীদের আয় বাড়ায়। উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।

আরও পড়ুন >>> সন্নিকটে সংকট, শঙ্কিত কি অর্থনীতি! 

২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষ এবং তার আগের বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোয় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

২০২২ সালের ওপেন ডোরস রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনাল এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, গত শিক্ষাবর্ষে বাংলাদেশ থেকে রেকর্ড সংখ্যক ১০ হাজার ৫৯৭ জন শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

১০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি, যা ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ৩ হাজার ৩১৪ জন থেকে বেড়ে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ১০ হাজার ৫৯৭ জনে দাঁড়িয়েছে।

আরও দক্ষ কর্মী

অন্যান্য প্রধান শ্রম-অভিবাসন গন্তব্যের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কম বাংলাদেশি নিযুক্ত থাকা সত্ত্বেও, দক্ষ অভিবাসীদের উচ্চতর আয় উল্লেখযোগ্য রেমিট্যান্স প্রদানে রূপান্তরিত হয়।

আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচ্যাম) ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল দাবি করেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে তাদের মজুরি বেশি হওয়ায় দক্ষ শ্রমিকরা যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হন। এই কারণেই হয়তো যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে।

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশিরা বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাচ্ছে এবং এখন যেহেতু একটি প্রজন্ম বড় হয়েছে, তারা দেশে টাকা পাঠাচ্ছে।

মাইগ্রেশন প্রবণতার পরিবর্তন—প্যাটার্নটি উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষাগত অভিবাসনের ক্ষেত্রে ধীর কিন্তু অবিচ্ছিন্ন বৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করে, যা লোভনীয় সুবিধা, বৃত্তি এবং উচ্চতর অধ্যয়নের সম্ভাবনা দ্বারা চাপ দেওয়া হচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সৌদি আরব বাংলাদেশের শীর্ষ শ্রম রপ্তানি দেশ, যা মোট কর্মী প্রেরণের প্রায় ৪০ শতাংশ। সৌদি আরবে রেমিট্যান্স প্রবাহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম। এর কারণ আসলে কী? নিম্নে বর্ণনা করা হলো।

আরও পড়ুন >>> আইএমএফের ঋণ : জ্বলছে কি জ্বালানি বাজার? 

হুন্ডি পদ্ধতি—মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো রেমিট্যান্সের জন্য অনানুষ্ঠানিক হুন্ডি ব্যবস্থার ওপর উল্লেখযোগ্যভাবে নির্ভর করে চলেছে, যা শ্রম রপ্তানি বৃদ্ধি সত্ত্বেও বৈধ চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে স্থানান্তরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ সীমাবদ্ধ করে।

বেকারত্ব এবং কম বেতন—অর্থনৈতিক অসুবিধার কারণে, মধ্যপ্রাচ্যে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিদেশি কর্মীদের জন্য কম বেতন দেখা গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নতুন করে জনশক্তি রপ্তানি হলেও দীর্ঘদিন ধরে দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছেন অনেকে। এসব ইস্যুর কারণে এই অঞ্চল, বিশেষ করে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে।

মার্চ মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে

ডলার সংকট শুরু হওয়ার পর দেশে রেমিট্যান্স প্রবেশের সংখ্যা কমে যায়। বাংলাদেশে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতরে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ সাধারণত উৎসবের সময় বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, প্রবাসী বাংলাদেশিরা মার্চ মাসে ২০২ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন, যা আগের বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। ঈদুল আজহায় রেমিট্যান্সে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে।

নন্দিতা রায় ।। গবেষক

Link copied