ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা কেন জরুরি?
তাহেরা খাতুন একজন কর্মজীবী নারী। বাসায় বয়স্ক মাকে রেখে প্রতিদিন কর্মস্থলে যান। প্রতিদিনের মতো অফিসের কাজ শেষে বাসায় ফিরে জানতে পারেন তার মা তীব্র জ্বর অনুভব করছেন। জ্বরের তীব্রতা দেখে তাহেরা এতটাই ঘাবড়ে যান যে তাৎক্ষণিক বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন, এমনকি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থাও ছিল না তার।
এক প্রতিবেশীর পরামর্শে তিনি তখন বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনলাইন জরুরি স্বাস্থ্যসেবা সার্ভিস স্বাস্থ্য বাতায়নে ফোন করে ডাক্তারের পরামর্শ নেন।
জরুরি প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া সম্ভব হয়েছে স্বাস্থ্যখাতে ডিজিটাল মাধ্যমের অগ্রগতির কারণে। এক্ষেত্রে ডা. বার্নাড লন-এর উক্তিটি খুব যুক্তিযুক্ত। তিনি বলেছেন, ‘যিনি অদৃশ্যকে দেখতে পারেন তিনিই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন।’
আরও পড়ুন >>> জীবন নিয়ে খেলা!
বর্তমান সময়ে ডিজিটাল মিডিয়া ব্যতীত দৈনন্দিন জীবনে কোনো কাজের কথা চিন্তা করা যায় না। নগর স্বাস্থ্যসেবাও এর বাইরে নয়। ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নগরবাসীর হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ।
ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা হলো, ডিজিটাল মাধ্যমের সাহায্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। বর্তমান বিশ্বে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে। কিন্তু দ্রুত বর্ধনশীল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে, আর তাই নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা সকলের কাছে পৌঁছে দিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।
সর্বশেষ ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩১.৪৯ শতাংশ নগরে বসবাস করে। নগরবাসীর মধ্যে প্রযুক্তি পণ্যের সহজপ্রাপ্যতা এবং ব্যবহার প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে স্বাস্থ্যসেবায় তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি কীভাবে সর্বজনীন করা যায় তা বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা হয়।
ই-হেলথ অ্যাপ্লিকেশনগুলো ব্যবহার করে টেলিমেডিসিন, ইলেকট্রনিক স্বাস্থ্য রেকর্ড (ইএইচআর), ক্লিনিক্যাল সিদ্ধান্ত জানানোর পদ্ধতি (সিডিএসএস), মোবাইল স্বাস্থ্য (এমহেলথ) অ্যাপ্লিকেশন, কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে ফিজিশিয়ানের পরামর্শ এন্ট্রি (সিপিওই), অনলাইন প্রেসক্রিপশন পদ্ধতি (ইপিএস) এবং ওয়েব-ভিত্তিক স্বাস্থ্য পরিসেবা (ডাব্লিউএইচএস) ইত্যাদি ব্যবহার করে আধুনিক ও মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে।
এরই মধ্যে মুঠোফোনেও হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমো, জুম ইত্যাদিসহ এমন সব অ্যাপস যুক্ত হয়েছে, যার মাধ্যমে চিকিৎসকেরা রোগীদের সেবা দিতে পারছেন যার যার অবস্থানে বসেই।
অনলাইন মিডিয়ায় স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল প্লাটফর্মের সংখ্যাও বাড়ছে। ডিজিটাল মিডিয়ার প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে টেলিমেডিসিন, ওয়েব-ভিত্তিক বিশ্লেষণ, ই-মেইল, মোবাইল ফোন অ্যাপ্লিকেশন, ক্ষুদে বার্তা, ডিজিটাল পরিধানযোগ্য ডিভাইসসহ হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার এর অন্তর্ভুক্ত।
আরও পড়ুন >>> স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা রুখবে কে?
ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে নাগরিকদের অসুস্থতা এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে স্মার্ট ডিভাইস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা হয়। এইক্ষেত্রে নগরের লোকজন অনলাইন বা হেল্পলাইনের সহায়তা নিয়ে থাকে।
হেল্পলাইনে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ফোন নম্বর থাকে। যেখানে কোনো ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা সেবার সুবিধা পেতে ফোন করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ফোনে পরামর্শ, কাউন্সেলিং, পরিসেবার অভিযোগ, সুবিধা, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সংক্রান্ত তথ্য অথবা প্রয়োজনীয় অন্যান্য তথ্যাদি।
বাংলাদেশে ডিজিটাল মাধ্যমে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও স্বাস্থ্য তথ্য ধারণাটি ১৯৯৮ সালে প্রথম প্রকল্প আকারে হাতে নেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প নিয়ে আসে। তারপর মূলত সমন্বিত ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা ও সমন্বিত স্বাস্থ্য তথ্য আহরণের প্রক্রিয়া বেশি গতি লাভ করে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে নগরে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করে। স্বাস্থ্যসেবায় ডিজিটাল মিডিয়ার এই বিস্তারের ক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক সমর্থন অন্যতম সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
সরকারের ডিজিটাল কার্যক্রমে স্বাস্থ্যসেবার সব কার্যক্রম আওতাভুক্ত করেছে। ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যাপক প্রসারের ফলে সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এইক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সেবাকে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচনা করে সব কার্যক্রম স্মার্ট পদ্ধতিতে রূপান্তর করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। দক্ষ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমন্বিত সেবা কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশন করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন >>> অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক সিলগালা : বেটার লেট দ্যান নেভার
সম্প্রতি চতুর্থ গ্লোবাল ডিজিটাল হেলথ পার্টনারশিপ (জিডিএইচপি) শীর্ষ সম্মেলনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার সব নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল সেবা ব্যবহারে গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে জাহিদ মালেক বলেন, দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধার উন্নতির জন্য এই ধরনের প্রযুক্তি তৃতীয় স্তরের স্বাস্থ্যসেবাগুলোয় ব্যবহার করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নগর স্বাস্থ্যসেবা ডিজিটাল মাধ্যমে প্রদানের লক্ষ্যে শহরে এমবিবিএস ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ব্যবস্থা করেছে। উক্ত টেলিমেডিসিন সফটওয়্যার ব্যবহার করে টেলিমেডিসিন কেন্দ্রে আসা রোগীরা ইন্টারনেটে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সরাসরি ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পারবে।
ডাক্তারের দেওয়া লিখিত প্রেসক্রিপশন ইন্টারনেট ব্যবহার করে সংগ্রহ করতে পারবে। এছাড়া আরও কিছু ব্যবস্থা রয়েছে উক্ত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেমন—ইলেক্ট্রনিক ডিজিটাল স্টেথোস্কোপ, ডিজিটাল ইসিজি এগুলো স্ট্যান্ড-ক্যামেরা ব্যবহার করে রোগীর শারীরিক পরীক্ষা করে রিপোর্ট সরাসরি ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিতে পারবে।
পাশাপাশি রোগীর উচ্চতা, ওজন, তাপমাত্রা, উচ্চ রক্তচাপ, ব্লাড গ্লুকোজ এগুলোও পরিমাপ করে টেলিমেডিসিন সফটওয়্যারের মাধ্যমে ডাক্তারের কাছে পাঠানো যাবে। আর এই সব তথ্য ইন্টারনেটের ক্লাউড স্টোরেজে সংরক্ষিত থাকবে যা ভবিষ্যতে ঐ রোগীর চিকিৎসায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
আরও পড়ুন >>> নকল ও ভেজাল ওষুধের প্রভাব ও প্রতিকার
তবে নগর স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে যেসব ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবহার করা হচ্ছে তার মধ্যে তথ্য আদান প্রদানের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে যেসব প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে সঠিক প্রচারণার অভাবে সেইগুলো সম্পর্কেও নগরের সব স্তরের মানুষের মধ্যে ধারণা নেই।
যারা ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে সেবা নিচ্ছে তাদের মধ্যে তথ্যের নিরাপত্তার বিষয়টি অনেকেই জানে না। কাজেই যাতে সব নাগরিক ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের করে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারে সেইজন্য সবার নিকট গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। সবার জন্য ব্যবহারযোগ্য একটি ডিজিটাল প্লাটফর্ম তৈরি করতে হবে।
সামগ্রিকভাবে নগরে বসবাসকারী নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্ত সব শ্রেণির জনগণ ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে যেন স্বাস্থ্যসেবার সুফল গ্রহণ করতে পারে সেই ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।
মো. মনিরুল হাসান (অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর) ও ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার (সিইও) ।। এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট