শিশুর জন্মগত হৃদরোগ থেকে মুক্তি মিলবে কীভাবে?
মোহনার বিয়ে হয় ২৮ বছর বয়সে। বিয়ের বছর খানেকের মধ্যে তিনি গর্ভবতী হন। গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে তার। ডাক্তারের পরামর্শে তিনি বেশকিছু ওষুধ খেয়েছিলেন তখন, কিন্তু তার রক্তে শর্করার মাত্রা পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণে ছিল না। প্রত্যাশিত সময়ে ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন তিনি।
শিশুটি অন্যান্য দিক থেকে সুস্থই ছিল কিন্তু ধীরে ধীরে শিশুটির শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। পাশাপাশি তার ঠোঁট ও জিহ্বা নীলচে হয়ে যায়। এরপর চিকিৎসক শিশুটির ইকোকার্ডিওগ্রাফি করেন এবং দেখতে পান, শিশুটির জন্মগতভাবেই হৃদরোগ রয়েছে।
গর্ভাবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত বা দুর্বলভাবে নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের পাশাপাশি মায়ের এমন অনেক সমস্যার কারণে নবজাতকের হৃদপিণ্ডে কিছু ত্রুটি তৈরি হতে পারে। যাকে জন্মগত হৃদরোগ বা কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ (সিএইচডি) বলা হয়।
আরও পড়ুন >>> শিশুরা কেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়?
ব্রিটিশ হার্ট ফেডারেশন জানাচ্ছে, বেশিরভাগ জন্মগত হৃদরোগের ক্ষেত্রে, ভ্রূণের প্রাথমিক বিকাশে কিছু ত্রুটি থাকে বা হৃদপিণ্ডের কিছু অংশ অপূর্ণ থেকে যায়। ত্রুটিপূর্ণ জিন বা ক্রোমোজোমের কারণে এমনটা হয়। কিন্তু প্রায়ই আমরা বুঝতে পারি না কেন শিশুর হৃদপিণ্ড স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হয় না। তবে জন্মগত হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে, গর্ভাবস্থায় মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে বা গর্ভাবস্থায় মা নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ (অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট বা অ্যান্টিপিলেপ্টিকস) খেয়ে থাকলে একটি শিশুর জন্মগত হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি হতে পারে [১]।
শিশুদের জন্মগত অন্যান্য রোগের মধ্যে, জন্মগত হৃদরোগে (সিএইচডি) আক্রান্তের সংখ্যা সর্বাধিক। এই সংখ্যা প্রতি ১,০০০ জীবিত জন্ম ৯.৩ পর্যন্ত ঘটে তবে অঞ্চলভেদে এর তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় অঞ্চলেই জন্মগত হৃদরোগের প্রকোপ বেড়েছে [২]।
হৃদপিণ্ডে চারটি কুঠুরি থাকে, এরমধ্যে উপরে দুটি কুঠুরিকে অলিন্দ্য এবং নিচের দুটি কুঠুরিকে নিলয় বলা হয়। অলিন্দ্যের মাঝখানে একটি পর্দা থাকে, এই পর্দার মধ্যে যদি ছিদ্র থাকে, তাহলে লক্ষণগুলো একটু দেরিতে প্রকাশ পায়। একইভাবে নিলয়ের মাঝখানে যে পর্দা থাকে, তার মধ্যে যদি ছিদ্র থাকে, তাহলে লক্ষণগুলো একটু দ্রুত প্রকাশ পায়।
শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞগণ বলেন, দেখা যায় যে, বাচ্চা যখন খেতে যাচ্ছে, তখন সে পুরোপুরি শক্তি দিয়ে টেনে খেতে পারছে না। অল্প একটু খাচ্ছে, আবার ছেড়ে দিচ্ছে এবং অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। কখনো কখনো নীল রঙের নখ বা ঠোঁট দেখা যায়। দ্রুত বা কষ্টকর শ্বাস প্রশ্বাস হতে পারে। এই ধরনের লক্ষণগুলো শুরুর দিকে থাকতে পারে।
লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো নির্দিষ্ট ত্রুটির ধরন এবং তীব্রতার ওপর নির্ভর করে। কিছু ত্রুটির জন্য কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ অল্প বা বেশি থাকতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান করার সময় কিছু জন্মগত হৃদরোগ সমস্যা শনাক্ত করা যায় (সাধারণত ২০-সপ্তাহের স্ক্যানে)। কিন্তু কখনো কখনো শিশুর জন্ম না হওয়া পর্যন্ত তা পাওয়া যায় না। আবার কিছু কিছু বিষয় শিশুর বয়স বাড়ার আগে এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত চিহ্নিত নাও হতে পারে।
আরও পড়ুন >>> জীবন নিয়ে খেলা!
শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে আরও জানা যায়, আগে শুধু এক্স-রে ও ইসিজি এই দুটি পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুদের হৃদরোগ শনাক্ত করা যেত। এরপরে এসেছে ইকোকার্ডিওগ্রাফি, যা দিয়ে সাধারণত শিশুদের জন্মের পরের হৃদরোগ শনাক্ত করা যায়।
এক্স-রের মাধ্যমে হার্টের গঠনগত পরিবর্তনগুলো ধরা পড়ে। যেমন—হার্ট অনেক সময় এগ শেফ (ডিমের মতো) বা বুট শেফ (জুতার মতো) আকার ধারণ করতে পারে, এটা এক্স-রে করলে ধরা পড়ে।
আবার অনেক সময় হার্ট বুকের তুলনায় অনেক বড় দেখা যায়। এসব লক্ষণ দেখলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ বুঝতে পারেন যে, নবজাতকের জন্মগত হৃদরোগ রয়েছে। ইকোকার্ডিওগ্রাফি এখন সব জায়গায় পাওয়া যায়। আর সহজেই এর মাধ্যমে জন্মের আগে ও পরে হৃদরোগ শনাক্ত করা যায়।
জন্মগত হৃদরোগে (সিএইচডি) আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা, হৃদপিণ্ডের ত্রুটির ধরন এবং তীব্রতার ওপর নির্ভর করে। কোনো কোনো আক্রান্ত শিশুদের হৃৎপিণ্ড বা রক্তনালি মেরামতের জন্য এক বা একাধিক অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে। তথ্যে জানা যায়, শিশু হৃদরোগের চিকিৎসা বিভিন্নভাবে করা হয়। যেমন—ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা, যাকে মেডিকেল ট্রিটমেন্ট বলা হয় এবং ইন্টারভেনশন প্রক্রিয়া, এটা আবার দুই ধরনের।
একটি হচ্ছে ওপেন হার্ট সার্জারি, অন্যটি হচ্ছে সার্জারি ছাড়াই বিভিন্ন ডিভাইসের মাধ্যমে হার্টের ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া। হৃদপিণ্ডের ছিদ্রগুলো যখন বড় থাকে তখন একে কমপ্লেক্স কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ বলে। এক্ষেত্রে ওপেন হার্ট সার্জারির প্রয়োজন পড়ে। হৃদপিণ্ডের ছিদ্রগুলো ছোট থাকলে বলে সিম্পল কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ, আর এক্ষেত্রে মেডিকেল ট্রিটমেন্ট অথবা ডিভাইসের মাধ্যমে হার্টের ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দিয়ে চিকিৎসা করা যায়।
আরও পড়ুন >>> অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক সিলগালা : বেটার লেট দ্যান নেভার
দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ খেতে থাকলে ছোট ছোট ছিদ্রগুলো স্বাভাবিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় রোগটি শনাক্ত করা গেলে এবং দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
আগে এসব সার্জারির জন্য বিদেশে যেতে হতো। কিন্তু এখন বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল এই ধরনের সমস্যা সমাধানে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। শুধু খেয়াল রাখতে হবে নবজাতকের শ্বাসকষ্টের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। শ্বাসকষ্টের কোনো সমস্যা দেখা দিলে সম্ভব্য দ্রুততম সময়ে শিশু চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হবে ততই শিশুর বিপদমুক্তির সম্ভাবনাও বাড়বে। তাই সরকারি বেসরকারি পর্যায় থেকে জনগণের মধ্যে আরও বেশি সচেতনতা বাড়াতে হবে।
হৃদপিণ্ড সংক্রান্ত রোগের বিষয়ে সবার মনোযোগ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ব হার্ট দিবস পালন করা হয়। যাতে বিশ্বব্যাপী মানুষ এই বিষয়ে জানতে পারে এবং হৃদরোগ সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
সবার উচিৎ হৃদরোগের লক্ষণ এবং কী ব্যবস্থা নিলে নিজেকে সুস্থ রাখা যায় তা জানা। সেই সাথে শিশুর জন্মের আগেই জেনে রাখতে হবে শিশু হৃদরোগের কারণ ও লক্ষণ সম্পর্কে। আমাদের আশপাশে যারা হৃদরোগে ভুগছেন তাদের কীভাবে সাহায্য করা যায় সেই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
তবে হৃদরোগের চিকিৎসার ব্যয় বহন করা অনেকের পক্ষেই বেশ দুরূহ হয়ে পড়ে। প্রিয়জনের সুস্থতার জন্য বিক্রি করতে হয় ভিটেমাটি। রোগি সুস্থ হলেও পরিবার পথে বসে যায়। তাই চিকিৎসা ব্যয় কীভাবে কমানো যায়, এই বিষয়টি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের গবেষক ও নীতি নির্ধারক সবাইকে ভাবতে হবে।
Reference:
- Understanding your congenital heart condition [Internet]. Br. Heart Found. [cited 2023 Aug 21]. Available from: https://www.bhf.org.uk/informationsupport/conditions/understanding-your-congenital-heart-condition
- Khan DrMMH, Rahman DrMdM, Ali DrMdM. The Prevalence and Risk Factor of Congenital Heart Defects in Bangladesh. Sch J Appl Med Sci [Internet]. 2022 [cited 2023 Aug 21];10:1903–7. Available from: https://saspublishers.com/media/articles/SJAMS_1011_1903-1907.pdf
শাম্মি আখতার, গবেষণা সহকারী; ও ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার (সিইও), এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট