ইসরায়েল-হামাস সংঘাত : আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইরানের আবির্ভাব?
ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে চলমান সংঘাত যেদিকে মোড় নিচ্ছে তাতে অনুমান করা যায় অন্তত লম্বা সময়ের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হতে যাচ্ছে।
তাতে ইসরায়েল, হামাস কোন পক্ষ লাভবান হবে তা একটি জটিল সমীকরণ। তবে এই লাভ ক্ষতির হিসাব চলাকালীন সময়ের মধ্যেই ‘দুই দেশের’ সাধারণ জনগণ যে অবর্ণনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ফিলিস্তিনের গাজা সীমান্তে লক্ষাধিক ইসরায়েলি সৈন্যের সমাগম বুঝিয়ে দিচ্ছে, গাজা উপত্যকায় স্থল অভিযান শুরু করা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
ইসরায়েলকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে ভূমধ্যসাগর অভিমুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার এর যাত্রা, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন-এর ইসরায়েল সফর এই সংঘাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ারও আভাস দিচ্ছে।
আরও পড়ুন
তবে ইসরায়েল, হামাস কিংবা প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতাকামী মানুষের বাইরেও আরেকটি দেশের নাম এবার শুরু থেকেই শোনা যাচ্ছে , আর সেইটি হচ্ছে ইরান।
পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য ২০০৩ সাল থেকে বিভিন্ন ধাপে ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের অর্থনৈতিক অবরোধ থাকলেও ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠার কার্যক্রমে কখনোই পিছু হটেনি।
মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর নেতৃত্বে সৌদি আরবের একচেটিয়া অবস্থান ইরান কখনোই সহজভাবে নেয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল এবং সৌদি আরবের মধ্যে নেওয়া সমসাময়িক উদ্যোগগুলো যখন আলোর মুখ দেখার পথে, ঠিক তখনি ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে হামাসের ত্রিমুখী হামলা শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বাধা তৈরি করেছে।
সংবাদমাধ্যমের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে একটি ধারণা পাওয়া গিয়েছে যে, হামলার দিন প্রথম ২০ মিনিটে হামাস ইসরায়েলের ভূখণ্ডের উদ্দেশে প্রায় পাঁচ হাজার রকেট নিক্ষেপ করে। গাজায় সীমান্ত ভেঙে ইসরায়েলের ভেতরেও প্রবেশ করে হামাসের সশস্ত্র বাহিনী।
দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার হিসেবে চিহ্নিত করা হয় গাজা উপত্যকাকে। যেখানে প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনি নাগরিক বসবাস করেন এবং এই সমগ্র উপত্যকাটি ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের নজরদারির মধ্যে থাকে।
এমন একটি সংবেদনশীল জায়গায় হামাস কীভাবে এত বড় আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে পেরেছে তা যেমন প্রশ্ন তুলছে ঠিক তেমনি আরেকটি প্রশ্ন উঠছে, কার থেকে, কোন জায়গায় হামাস এই অত্যাধুনিক রকেট, সমরাস্ত্র পেয়েছে?
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, হামাসের সবচেয়ে বড় সহযোগী লেবানন ভিত্তিক শিয়া সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। আদর্শগত মিলের কারণে ইরানের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে হিজবুল্লাহর। লেবানন এবং ইরানের মাঝে অবস্থান করা সিরিয়ায় ইরানের প্রক্সি উপস্থিতিতে প্রায়ই পরিচালিত হয়ে থাকে তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।
আরও পড়ুন
পশ্চিমা বিশ্ব ইতিমধ্যেই ইরানের দিকে আঙুল তুলেছে হামাসকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করার অভিযোগে। যদিও তার পক্ষে কোনো শক্ত প্রমাণ তারা এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেনি। তবে তাদের অভিযোগ যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তবে নিঃসন্দেহে এইবারের ইসরায়েল—প্যালেস্টাইন সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইসরায়েলের একছত্র আধিপত্যে ছেদ টানবে।
চীন, রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট ইরান সময়ে সময়ে বেশ ভালোভাবেই তার শক্তি প্রদর্শন করেছে। অপরদিকে ধর্মীয় আদর্শের ভিন্নতা থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো তাদের নিরাপত্তার প্রধান অন্তরায় মনে করে ইসরায়েলকে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলের পক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন এটি একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নেওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশও জড়িয়ে পড়তে পারে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে। আর তাই দেশগুলোর এই ইসারায়েল বিরোধী মনোভাব তাদের অবস্থানকে ইরানের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
তাই মানবাধিকার বিষয়ে ২০২২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোণঠাসা ইরান তার সহযোগী দেশগুলোর সমর্থনে, ‘ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন’ সংঘাতকে কেন্দ্র করে নিজের ‘সর্বোচ্চ শক্তি’ প্রদর্শনের মাধ্যমে এই অঞ্চলে পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় সম্ভাবনাকে একদম বাতিল করে দেওয়া যাচ্ছে না।
শাফাআত হিমেল ।। সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক