বাংলাদেশের এভিয়েশন এবং ট্যুরিজমের এগিয়ে চলা
বিশ্বের অনেক দেশ আছে যাদের জিডিপির মূল আয়ের খাতই হচ্ছে ট্যুরিজম। আবার অনেক দেশ আছে আয়ের অন্যতম খাত ট্যুরিজম। আর ট্যুরিজম প্রায় শতভাগ নির্ভর করে এভিয়েশন খাতের উপর। এভিয়েশন আর ট্যুরিজমের ওপর নির্ভর করে হাজার হাজার ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর। ট্যুরিজমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হাজার হাজার আবাসিক হোটেল আর রেস্টুরেন্ট। সবকিছু মিলিয়ে এই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কয়েক লাখ কর্মীবাহিনী। যাদের শুধু মাসিক আয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ থাকলেই তাদের কর্মের নিশ্চয়তা থাকে, আয়ের নিশ্চয়তা থাকে। ব্যবসা বন্ধ তো আয়ের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাদের প্রতি মুহূর্তে সামাজিকভাবে নিগৃহীত হতে হয়। আয়ের পথ বন্ধ হলেও বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটি খরচ বহমান থাকে। শুধু হতাশায় নিমজ্জিত থেকে কিভাবে একজন কর্মী তার আয়-ব্যয় এর হিসাব মেলাবে?
শুধু কর্মীর কথা উল্লেখ করলে যথার্থতা পাবে না। ট্যুরিজম এবং এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি যদি স্তব্ধ হয়ে যায়, এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীরা নানাভাবে বিপর্যস্ত হতে থাকে। ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের দায়, কর্মীদের জীবন-জীবিকা নিয়ে ভাবনা ইত্যাদি বিষয়গুলো সামনে ওঠে আসে। ভবিষ্যতে এই খাতে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত হতে পারেন অনেক বিনিয়োগকারী। কিংবা বর্তমান ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারেন অনেকেই।
উপরের কথাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে গত দু’যুগ ধরে এগিয়ে চলা এভিয়েশন এবং ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির হালচাল দেখেই। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি। অনেক পরিকল্পনা নিয়ে শুরু করা একটি এয়ারলাইন্স কোম্পানি শত কোটি টাকা বিনিয়োগের কিছুদিনের মধ্যেই ব্যবসা গুটিয়ে চলে যেতে হয়েছে। শুরু আর শেষের মধ্যে অনেক না পাওয়ার কাব্যকথা লুকিয়ে থাকে।
অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে দেশীয় এয়ারলাইন্স তথা দেশের নাগরিকদের কথা বিবেচনা করে যৌক্তিক হারে বিভিন্ন চার্জ নির্ধারণ করলে আকাশপথে ভ্রমণ অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। যা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখবে।
ব্যবসা শুরু হয় শূন্য থেকে কিন্তু শেষের গল্প থাকে অনেক করুণা আর বঞ্চনার মিশ্রণে ভরপুর। বিনিয়োগকৃত অর্থ চলে যায় শূন্যেরও নিচে। এর সাথে জড়িত অনেক কর্মীর জীবন কাহিনী হয়ে উঠে কর্মহীনতার গল্প নিয়ে। এভাবেই এগিয়ে চলছে এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি। যা কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ নয়।
বাংলাদেশ এভিয়েশনের রেগুলেটরি অথরিটি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এভিয়েশন ব্যবসায় সম্পৃক্ত প্রত্যেকটি এয়ারলাইন্স কোম্পানি। অনেক পাওয়ার সাথে অনেক না পাওয়ার গল্পও আছে এভিয়েশন ব্যবসায়। প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা মানেই এভিয়েশন ব্যবসা। উন্মুক্ত আকাশের মতোই উন্মুক্ত ব্যবসা কিন্তু বহির্বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে নিজ দেশের এয়ারলাইন্সগুলোকে কিছুটা সাবসিডি দেওয়া যেতে পারে। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশের এক কোটি নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। আর এই বিশাল মার্কেটের বৃহদাংশই চলে যাচ্ছে বিদেশি এয়ারলাইন্স এর কাছে।
বাংলাদেশ এভিয়েশন মার্কেট সব দেশের এয়ারলাইন্স এর কাছে একটি লোভনীয় মার্কেট। অনেক বিদেশি নতুন নতুন এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে দেশীয় এয়ারলাইন্সকে টিকিয়ে রাখার জন্য জেট ফুয়েল, অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ, এয়ারলাইন্স এর বিভিন্ন যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্কসহ নানাবিধ চার্জগুলোর ক্ষেত্রে যৌক্তিক হারে সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে দেশীয় এয়ারলাইন্স তথা দেশের নাগরিকদের কথা বিবেচনা করে যৌক্তিক হারে বিভিন্ন চার্জ নির্ধারণ করলে আকাশপথে ভ্রমণ অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। যা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখবে।
এভিয়েশন মার্কেটের অগ্রযাত্রার সাথে সাথে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ট্রাভেল এজেন্সি। আজ যদি বাংলাদেশের এভিয়েশন মার্কেট ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাথে সাথেই ট্রাভেল এজেন্সিগুলো পর্যুদস্ত হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এভিয়েশন মার্কেটের অগ্রযাত্রার সাথে সাথেই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পাঁচতারকাসহ অনেক নামীদামী হোটেল।
দেশের এভিয়েশনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে গড়ে উঠেছে অনেক পর্যটনকেন্দ্র। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পর্যটনকেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখার প্রবণতা দিনদিন বাড়তে শুরু করেছে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক ট্যুর অপারেটর, যারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করে, পর্যটকদের আগ্রহ তৈরিতে সহায়তা করে। সবকিছুর মূলেই আছে এভিয়েশন।
দুঃখজনক হলেও সত্য গত দু’যুগে প্রায় ৭ থেকে ৮টি বেসরকারি এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে গেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জিএমজি এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, বেস্ট এয়ার, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। বর্তমানে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও নভো এয়ার ব্যবসা পরিচালনায় টিকে আছে। অনেকেই এভিয়েশন ব্যবসায় বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করার পরও পূর্ববর্তী কোম্পানিগুলোর অবস্থান বিবেচনায় অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। অনেক স্বপ্নের ফসল হতে যাচ্ছে আধুনিকায়নের অন্যতম টার্মিনাল হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল। এর থেকে পরিপূর্ণ সুবিধা পেতে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোকে পূর্ণ প্রতিযোগিতায় আনতে সহায়তা প্রদান করা খুবই জরুরি। নতুবা বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশ মার্কেটকে নিজেদের দখলে নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করবে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আপনার, আমার সোনার বাংলাদেশ।
দেশের এভিয়েশনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে গড়ে উঠেছে অনেক পর্যটনকেন্দ্র। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পর্যটনকেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখার প্রবণতা দিনদিন বাড়তে শুরু করেছে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক ট্যুর অপারেটর, যারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করে, পর্যটকদের আগ্রহ তৈরিতে সহায়তা করে। সবকিছুর মূলেই আছে এভিয়েশন।
বর্তমান করোনাকালীন সময়ে বিশ্বময় দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এভিয়েশন খাত। সেই সাথে বিশ্বের হোটেল ইন্ডাস্ট্রি, ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির সাথে সংশ্লিষ্ট লক্ষ লক্ষ ট্রাভেল এজেন্সি ও ট্যুর অপারেটর। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এই ইন্ডাস্ট্রিকে কোথায় নিয়ে যাবে তা অনুধাবনও করা যাচ্ছে না। এভিয়েশন এবং ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখতে এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান যেন সুবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত নেন এই প্রত্যাশা করছে এই ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত সকলে। নতুবা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সারাবিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা বাংলাদেশ এভিয়েশন এবং ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি।
যেকোনো পরিবহনের চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্য সতর্কতা মেনে যাত্রী পরিবহন করে থাকে এয়ারলাইন্সগুলো। হঠাৎ করে আকাশ পথে অন্য পরিবহনের মতো লকডাউন ঘোষণা, যারপরনাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় এয়ারলাইন্সগুলোকে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নানা বিধি-নিষেধের মধ্যেই শ্রমিকরা কাজের সন্ধানে যাতায়াত করছে। হঠাৎ করে লকডাউনের সিদ্ধান্তে ভিসা জটিলতা তৈরি হবে, কাজ হারানোর আশঙ্কা তৈরি হবে, ইতোমধ্যে নানা অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে সবার মাঝে। সেই সঙ্গে অনেকেই চিকিৎসা সুবিধা নিতে ভারতসহ সিঙ্গাপুরে ট্রাভেল করছে, হঠাৎ করে লকডাউনের বেড়াজালে পড়ে জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে অবস্থান করছে।
সার্বিক দিক বিবেচনায় এয়ার বাবল চুক্তির অধীনে ফ্লাইট পরিচালনা অব্যাহত রাখা যায় কিনা তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছেই বিবেচনার জন্য আবেদন রাখা যায়। সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে এভিয়েশন এবং ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির লক্ষাধিক কর্মী আর হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের কথা, সাথে বিশ্বের কাছে দেশের যোগাযোগর কথা বিবেচনায় রেখে এই ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে সুবিবেচনা প্রত্যাশা করছে লক্ষ লক্ষ কর্মী।
মো. কামরুল ইসলাম ।। মহাব্যবস্থাপক- জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স